আহসানুল কবীর ।।
ঘড়ির কাটায় ভোর ছয়টা
মোবাইলে রিং বাজছে আর আমি আলস্য ঘুমের ঘোরে কেটে দিচ্ছি। একটি ক্ষুদে
বার্তা আসলো মিজান ভাই ভারতে মারা গেছেন। বুকটা ধক করে উঠলো। আবার ভাবছি
কেউ হয়তো ফান করছে। তারিকুর রহমান জুয়েলকে ফোন দিলাম। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে
পড়লো। ঘটনা সত্য ? শুরু হলো ফোনের বন্যা। অসংখ্য ফোন আসছে। আমি বাকরুদ্ধ,
স্তব্দ চেয়ে থাকি। সারে সাতটায় আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের ফোন ঘটনা কি
সত্য। কিছুক্ষণ পর মুজিব রণাঙ্গনের বৈরী সময়ের সিপাহশালার আ জ ম নাসিমের
ফোন কিভাবে হলো ? ষাটের দশকের তুখোর ছাত্রনেতা মফিজুর রহমান বাবলু এবং
রাশেদা রহমানের ক্রন্দনসিক্ত ফোন মিজান আমাদের কাছে সন্তান তুল্য। এরশাদ
বিরোধী আন্দোলনের তুখোর ছাত্রনেতা নাসিরুদ্দিনের উদ্দিনের ফোন কবীর কোন
ভাবেই মানতে পারছিনা। এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাহসী সৈনিক চিত্তরঞ্জন
ভৌমিক বলছেন মিজান প্রায়ই বলতো ‘আমার জন্য তোমরা একদিন দু:খ করবা’ কথাটি
এত সত্য হয়ে গেল ? এনএসআই মনসুর আহম্মদ বিপ্লব নিজে অসুস্থ হয়ে বিএসএমএম
ইউতে ভর্তি। সেখান থেকে ফোন করে বললেন আমাদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন মিজান
ভাই। উপরের কথাগুলো সামগ্রিক অনুভূতির ক্ষুদ্র প্রকাশ মাত্র। ভোর থেকে রাত
অবধি অন্তত: পাঁচশত ফোন রিসিভ করেছি। অভিমান নিয়ে রাজনীতি থেকে চলে যাওয়া
একধরণের বৈরীময় জীবন যাপন করা লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা মিজানুর রহমান
আজাদের শিকড় এতো গভীরে প্রোথিত তা কখনও চিন্তা করিনি। আমরা যারা এরশাদ যুগে
কিংবা ৭৫ পরবর্তী দু:সময়ে ছাত্ররাজনীতিতে এসেছি তাদের কাছে মিজানুর রহমান
আজাদ এবং আবেগ মথিত ভালবাসার নাম। আমাদের প্রজন্মকে বৈরী স্বাপদ সংকুল সময়ে
স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন মিজানুর রহমান আজাদ। যখন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ
করা কঠিন তখন আমাদের মতো একদল স্বপ্নবাজ মুজিব প্রেমিক তৈরি করেছেন মিজানুর
রহমান আজাদ। পাথরে ফুল ফোটানোর মত করে মুজিব বাগানে এক একটি গোলাপ তিনি
সৃষ্টি করেছেন। যে গোলাপ গুলো যখন সৌরভ ছড়াচ্ছে তখনই বড় অবেলায় চলে গেলেন
তিনি। নিয়তির এ কেমন বিধান !
শিশুকালেই হারিয়েছেন পিতাকে। পিতা শহীদ
মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান ১৯৭১ এ ফেনী সীমান্তে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে
সম্মুখ সমরে শহীদ হন। সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। মায়ের আদরে ছোট দুটি
ভাই জুয়েল ও পিপুলকে নিয়ে বড় হয়েছেন। কুমিল্লা জিলা স্কুলের ফুটবল টিমের
অপরিহার্য খেলোয়ার ছিলেন। ভালো টেবিল টেনিস খেলতেন। পছন্দ করতেন নাটক দেখতে
সিনেমা দেখতে। ফ্যাশনেবল ড্রেস পড়ে কেতাদূরস্ত হয়ে চলতে পছন্দ করতেন। সেই
ছেলেটি হতে পারতো একজন ভালো খেলোয়ার হতে পারতো আমলা। কিন্তু নিয়তির লিখন
ছিল ভিন্ন। সারাদিনমান বন্ধুদের নিয়ে অলস আড্ডায় মেতে থাকা বন্ধুবৎসল
ছেলেটি জড়িয়ে গেল ছাত্র রাজনীতির ডামাডোলে। ১৯৮১ সনে ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র
সংসদ নির্বাচনে দল তাকে সফিক-জাহাঙ্গীর পরিষদের এজিএস হিসাবে মনোনয়ন
প্রদান করলো। সেই থেকে শুরু। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কঠিনতর সময়ে
ছাত্রলীগের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন। একক প্রচেষ্টায় ভিক্টোরিয়া কলেজ তো
বটেই পাড়ায় পাড়ায় ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেছেন নিদারুণ দক্ষতায়। জেলা
ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক নির্বাচিত হন দুদফায়। ১৯৮৬ সনে ছাত্র শিবিরের সৈয়দ
মোতাহের আলী দিলাল এবং ছাত্রদলের মফিজুল আনোয়ার ডিলনের মত ছাত্রনেতাদের
হারিয়ে ভিক্টোরিয়া কলেজের ভিপি নির্বাচিত হলেন তুমুল জনপ্রিয়তায়। একই বছর
তিনি কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
রাজনৈতিক
প্রতিপক্ষের দিকে তার বন্ধুত্বের হাত ছিল সর্বদা প্রসারিত। ভিক্টোরিয়া কলেজ
তখন শিবির আর ছাত্রদল ছাত্রলীগের প্রবল প্রতিপক্ষ। কথায় কথায় মারামারি।
কিন্তু মিজানুর রহমান আজাদের গ্রহণযোগ্যতা সবার কাছে। ছাত্রলীগের
অভ্যন্তরীণ বিরোধও তখন তুঙ্গে। কলেজে কিংবা শহরে দু-গ্রুপের মারামারি।
কিন্তু মিজান ভাই প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতা পার্থ দা কিংবা জাকির ভাইকে নিয়ে
এক রিকশায় শহর ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ এক অভাবনীয় দৃশ্য। আজকের দিনে কি এটা
কল্পনা করা যায় ? যে কোন রাজনৈতিক কর্মীর প্রতি তার মমত্ববোধ ছিলো অপরিসীম।
গত দুইদিনে কুমিল্লা শহরে দলমত নির্বিশেষে সমস্ত রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে
যে হাহাকার এটাইতো একজন রাজনৈতিক কর্মীর জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
বর্তমানের ঘুনে ধরা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মন্ত্রী এমপি অনেকই হতে পারে কিন্তু
মানুষের ভালোবাসা কজনে পায় ? মানুষের ভালোবাসা সহকর্মীদের মমত্ববোধ তিনি
পেয়েছেন আমি মনে করি। এটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। অর্থ দিয়ে নয়
অস্ত্র দিয়ে নয় সম্পর্ক তৈরি করে ভালো আচরণ দিয়েও সংগঠন তৈরি করা যায় কর্মী
সৃষ্টি করা যায় মিজানুর রহমান আজাদ তার জলন্ত উদাহরণ। শুধুমাত্র বাগ্মিতা
দিয়ে কথার যাদু দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে জনসভায় ধরে রাখার একটা অসাধারণ
গুণ ছিলো মিজানুর রহমান আজাদের। নিকট অতীতে এত বহুমাত্রিক গুণাবলীর অধিকারী
ছাত্রনেতা খুব কমই চোখে পড়ে। যে কোন সমালোচনা হাসিমুখে গ্রহণ করার বিরল
ক্ষমতা ছিলো তার।
মিজানুর রহমান আজাদের সাথে আমি শাপলা কুঁড়ির আসরের
সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। আজ থেকে একত্রিশ বছর আগে তিনি তখন ছাত্ররাজনীতির
মধ্যেগগনে আর আমি সদ্য স্কুল পাশ করা কিশোর সে অর্থে তিনি সভাপতি আমি
সাধারণ সম্পাদক এটি একটি অসম জুটি। কিন্তু তিনি কখনও আমাকের পাশ কাটিয়ে কোন
সিদ্ধান্ত নেননি। প্রতিটি কাজে আমার মতামতের গুরুত্ব দিতেন। এখানেই তার
মহাত্ম্য।
সাফল্য ব্যর্থতা কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথার্থতা মানুষের
জীবনের স্বাভাবিক অংশ। ভুল-শুদ্ধ বিষয়টি আসলে আপেক্ষিক। মিজানুর রহমান আজাদ
তার নব্বই পরবর্তী রাজনীতিতে কি ভুল করেছেন কিংবা ভুল না করলে কি হতে
পারতেন কতদূর যেতে পারতেন তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। আমরা বরং সেদিকে না
যাই। আমরা আমাদের সকল সিদ্ধান্ত জেনে বুঝে নেই এমন না। কোন কাজে সফল হতে
পারলে সব সিদ্ধান্তই সঠিক আর ব্যর্থ হলে সকল সিদ্ধান্ত ভুল। আমরা বরং মনে
রাখবো আশির দশকের সেই হাসিমুখের তরুণ মুখটিকে যে অসম্ভব বৈরী পরিবেশেও
সহকর্মীদের উজ্জীবিত করার সঞ্জীবনী ক্ষমতা ধারণ করতেন। রাজনৈতিক
প্রতিপক্ষকে যিনি প্রতিহিংসা কিংবা প্রতিশোধ পরায়ণতা নয় ভালোবাসা দিয়ে জয়
করতেন। আমরা মনে রাখবো সেই মিজান ভাইকে যে কোন সহযোদ্ধা অভিমান করলে অভিমান
ভাঙানোর জন্য ছুটে আসতেন। বুকে তুলে নিতেন পরম মমতায়। এসমস্ত কারণে তিনি
আমাদের মাঝে প্রাসঙ্গিক থাকবেন আরো অনেকদিন। প্রিয় মিজান ভাই-
‘নয়ন সমুখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই
আজি তাই
শ্যামলে শ্যামল তুমি
নীলিমায় নীল’।
লেখক: সাবেক ছাত্রলীগ নেতা