ড. কাজী মারুফুল ইসলাম ||
বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানী এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মোটা দাগে এ রকম একটি ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, চলমান করোনা মোকাবিলায় টিকা নেওয়ার চেয়ে অধিকতর কার্যকর কোনো বিকল্প এই মুহূর্তে কাছে নেই। এপ্রিল মাস থেকে চলা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করতে গিয়ে টিকার গুরুত্ব নতুন করে সামনে এসেছে। করোনা টিকা সংগ্রহে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে ছিল। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত তিন কোটি কোভিশিল্ড টিকা সংগ্রহের চুক্তি করে। এ চুক্তি অনুযায়ী ছয় মাসের মধ্যে সব টিকা আসার কথা, এখন পর্যন্ত এক কোটি তিন লাখ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। পরের চালানগুলো চুক্তিমতো না আসায় বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি অনিশ্চয়তায় পড়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ৩ মে পর্যন্ত দেশে ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ৭১৯ জনকে প্রথম ডোজ এবং ৩০ লাখ ২৩ হাজার ১৬৯ জনকে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। ভ্যাকসিন স্বল্পতার কারণে সরকার প্রথম ডোজ দেওয়া স্থগিত করেছে। এখন দেওয়া হচ্ছে শুধু দ্বিতীয় ডোজ। যে পরিমাণ টিকা মজুদ আছে, তাতে প্রায় ১৩ লাখ মানুষের দ্বিতীয় ডোজ সময়মতো দেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। নিয়ম অনুযায়ী পূর্ণ সুরা পেতে দ্বিতীয় ডোজটি প্রথম ডোজের ১২ সপ্তাহের ভেতরে নিতে হবে। বাস্তবতা হলো, বর্তমান পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন না হলে আগামী জুলাই মাসের আগে সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
এমন পরিস্থিতিতে সরকার একাধিক উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, আগামী চার মাসের মধ্যে দুই কোটি টিকা সংগ্রহের ল্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। ইতোমধ্যে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি এবং চীনের সিনোফার্ম কোম্পানির টিকা জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার নীতিগতভাবে স্পুটনিক-ভি ও সিনোফার্মের টিকা দেশে উৎপাদনের অনুমোদন দিয়েছে। এ ছাড়াও দুই সপ্তাহের মধ্যে উপহার হিসেবে সিনোফার্মের পাঁচ লাখ ডোজ টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে প্রয়োজনীয় টিকার বড় অংশ সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমন্বয়ে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে সংগ্রহের আশা করছে, যেখান থেকে বাংলাদেশের একাধিক ধাপে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা। এই কোভ্যাক্সের মাধ্যমে সংগৃহীত টিকার মধ্যে ফাইজার ও মডার্নার তৈরি টিকা থাকবে। এ বছরের তৃতীয় ভাগে গিয়ে দেশে একই সময়ে সেরাম (অক্সফোর্ড), স্পুটনিক, সিনোফার্ম, ফাইজার এবং মডার্নার প্রস্তুত করা ভিন্ন ভিন্ন প্রযুক্তির পাঁচ রকম টিকার প্রয়োগ চলবে। এ রকম হলে তা হবে অনন্য। এখন পর্যন্ত অন্য কোনো দেশের েেত্র এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এ অবস্থায় এমন প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক, বাংলাদেশ কি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কভিড টিকার এক বৃহত্তর পরীাগারে পরিণত হতে যাচ্ছে? প্রশ্নটা বিচার করতে হবে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকির জায়গা থেকে। এখানে কয়েকটি বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য-উদ্বেগের বিষয় রয়েছে।
প্রথমত, স্পুটনিক-ভি এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায়নি। মাত্র কয়েকদিন আগে চীনের সিনোফার্মের টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। এ দুটি টিকা ইউরোপ, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানেরও অনুমোদন পায়নি। তাহলে আমাদের ঔষধ প্রশাসন কীসের ভিত্তিতে এত দ্রুত টিকা দুটিকে অনুমোদন দিল? দ্বিতীয়ত, টিকা উৎপাদন এবং সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সংশ্নিষ্ট দেশের সরকারের কাছ থেকে কোম্পানির কাছে চলে গেছে। বহুজাতিক করপোরেট উৎপাদনকারীদের সঙ্গে নেগোশিয়েট করে বাংলাদেশের মতো দেশের পে কীভাবে জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব? তৃতীয়ত, এই বিবিধ রকম টিকা সংরণ, প্রয়োগ-ব্যবস্থাপনা এবং টিকা-পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেণে যে বৈজ্ঞানিক এবং তথ্য-অবকাঠামো থাকা দরকার, তা কি আমাদের আছে? চতুর্থত, এতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশে টিকা ব্যবস্থাপনায় কারিগরি সহায়তা দিয়ে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ফলে এক ধরনের স্বস্তির জায়গা ছিল। কিন্তু এই কভিড টিকা ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কার্যত অনুপস্থিত দেশে এবং আন্তর্জাতিক উভয় েেত্র। ফলে টিকা সংক্রান্ত জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের সমতা খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। পঞ্চমত, যখন দেশে একাধিক ব্র্যান্ডের টিকা প্রয়োগ করা হবে, তখন কে কোন টিকা পাবেন, তা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে? টিকা প্রয়োগের আগে নাগরিকদের সচেতন-সম্মতির ব্যাপারটা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? ষষ্ঠত, পরিস্থিতি কি এমন হতে পারে, একজন প্রথম ডোজ নিয়েছেন এক কোম্পানির, কিন্তু দ্বিতীয় ডোজ নিতে হচ্ছে অন্য কোনো কোম্পানির? এ েেত্র কোনো টিকা গ্রহণকারী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার দায় কে নেবে? সরকার কীভাবে এই নাগরিকদের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে?
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সর্বব্যাপী টিকা প্রয়োগের গুরুত্ব নির্দ্বধিায় স্বীকার করে নিয়েও বলতে হবে, উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া জরুরি। দুঃখজনক হলো, কোনো বিপদ সংঘটিত হলে আমরা দেখি তার দায় সংশ্নিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো বিবিধ অসিলায় এড়িয়ে যায়। কোনো অনিয়মের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনার নজির প্রায় নেই বললেই চলে। এ রকম রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সংস্কৃতির মধ্যে চার-পাঁচ রকম টিকা প্রয়োগের ফলে কোনো নাগরিকের তি হলে তার দায়িত্ব কে নেবে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিভিন্ন টিকা উৎপাদন কোম্পানির জন্য একটা বিশাল পরীাগারে পরিণত হতে চলেছে, যেখানে এসব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের টিকার কার্যকারিতা তুলনামূলক মূল্যায়ন করতে পারবে। যে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যুক্ত হওয়া যেতেই পারে। কিন্তু তার আগে দরকার জনস্বাস্থ্যের সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ এবং সার্বণিক নজরদারি।
অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়