শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
সপ্তম পর্ব--
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯২০ সালে ৪৯নং পল্টন ভেঙে দেয়া হয়। কাজী নজরুল ইসলাম ঐ পল্টনের অধীনে হাবিলদার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত সৈনিক ছিলেন। তিনি তখন কলকাতায় চলে আসেন। যুদ্ধফেরতা সৈনিকদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং এ ধারায় তাঁকে সাব-রেজিস্টার পদে চাকরি দেয়া হয়েছিল। তিনি তা গ্রহণ করেননি। লক্ষ্য করা গেছে যুদ্ধ থেকে ফিরে নজরুল ইসলামের মধ্যে স্বাদেশিকতা অর্থাৎ দেশপ্রেম বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে এবং আত্মসম্মানবোধের বিষয়ও জাগ্রত হয়। অর্থাৎ তিনি স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেসময় কলকাতায় কমরেড মুজফফর আহমদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর আশ্রয়ে নজরুল ইসলাম কলকাতায় আস্তানা ঠিক করে নেন। আমরা জানি, কমরেড মুজফফর আহমদ ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি নজরুল ইসলামকে আশ্রয় দিলেও রাজনৈতিক আদর্শে সহযোগী হতে কোনোদিন প্রভাবিত করেননি। নজরুল ইসলামও রাজনীতি নিয়ে তখন তেমনভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেননি। এ ধারায় দেখি মুজফফর আহমদ ও নজরুল ইসলামের যৌথ সম্পাদনায় ‘নবযুগ’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
নজরুল ইসলাম যখন ১৯২১ সালে এপ্রিলে আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে কুমিল্লা এলেন, তখন তাঁর প্রাথমিক পরিচয় ছিল যুদ্ধফেরতা হাবিলদার কবি। অর্থাৎ সৈনিক থাকাকালীন কবিতা-গান-ছোটগল্প লিখে নাসির উদ্দিন সাহেবের ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন এবং প্রকাশিত হয়। তবে এ পরিচিতি তখনও ব্যাপকতা লাভ করেনি। পরবর্তীতে নজরুল ইসলাম বার বার কুমিল্লায় এসেছেন, তখন কুমিল্লার কংগ্রেস নেতা ছিলেন বসন্তকুমার মজুমদার। তিনি কুমিল্লা জেলায় যুগান্তর পার্টি সংগঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভা মজুমদার ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসে যোগদান করেন। ১৯২১ সালে চাঁদপুর ও গোয়ালন্দ স্টিমার-ধর্মঘটে তিনি সর্বরকমে স্বামীকে সহায়তাদান এবং সে সময় গোয়ালন্দে একটি স্বেচ্ছাসেবিকা দল গঠন করেন। নারায়ণগঞ্জের স্টিমার ধর্মঘটেও সহায়তা দেন এবং ‘মহিলা কর্মী সংসদ’ গঠন করেন।
বসন্তকুমার ও হেমপ্রভা দম্পতির সঙ্গে ১৯২১ সালেই পরিচয় ঘটে। প্রথম পরিচয়টা ছিল আকস্মিক। নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালে নভেম্বরে যখন দ্বিতীয়বার এলেন এবং ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় অবস্থান করছিলেন, তখনই শহরবাসী জেনে যায় নজরুল ইসলাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরতা হাবিলদার সৈনিক, তিনি কবিতা ও গান লিখেন, গান পরিবেশন করেন এবং অসাধারণ বাঁশি বাজান। তাই বিশেষত কলেজ ছাত্র, যুবক ও উৎসাহীরা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় এসে ভীড় জমায় এবং নজরুল ইসলামের মুখে আবৃত্তি, গান এবং বাঁশি শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু সেনগুপ্তের বৈঠকখানার পরিসর ছোট হওয়ার কান্দিরপাড়ের বসন্তকুমার মজুমদারের বৈঠকখানায় আসর বসে, সেখানে নজরুল ইসলাম উপস্থিত সকলকে কবিতা-আবৃত্তি, গান ও বাঁশি বাজিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন। তখনই বসন্ত-হেমপ্রভা দম্পতির সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। হেমপ্রভা মজুমদার নজরুলকে সন্তানের মতো গ্রহণ করেন।
১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে প্রিন্স অব ওয়েলস ভারতে আসবেন। এজন্য প্রতিবাদ স্বরূপ দেশময় হরতাল ও হাঙ্গামা হয়েছিল। এই প্রতিবাদের ঝড় কুমিল্লায় ওঠে। বীরেন সেনগুপ্ত ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার অনুরোধে নজরুল ইসলাম মিছিলে গাওয়ার জন্য ‘জাগরণী’ নামে একটি গান রচনা করেন। যেখানে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছিল সকল বাড়িতে দীপ জ্বালাতে হবে, বাড়ির সম্মুখে কদলীবৃক্ষ রোপণ ও জলভরা মঙ্গলঘট সহকারে শাখা দিয়ে সাজাতে হবে। নজরুল তাঁর গানে প্রতিবাদস্বরূপ লিখলেন-
‘কার তরে জ্বাল উৎসব দীপ।
দীপ নেবাও। দীপ নেবাও।
মঙ্গল ঘট ভেঙ্গে ফেল,
সব গেল মা গো সব গেল।
অন্ধকার! অন্ধকার!
ঢাকুক এ মুখ অন্ধকার
দীপ নেবাও। দীপ নেবাও।
এ যে প্রকাশ্যে রাষ্ট্রবিরোধিতা। নজরুলের সাহসের কাছে যে মাথা নত করতে হয় তখনও এবং এখনও। তিনি যখন গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে ‘জাগরণী’ গান গেয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তাঁর সঙ্গে বীরেন সেনগুপ্ত, খিলাফত আন্দোলনের নেতা আফতাবুল ইসলামসহ শতাধিক মিছিলকারী এবং বীরেন সেনগুপ্তের জ্যেষ্ঠতাত বোন আশালতা, আপনবোন কমলা ও অঞ্জলি এবং বসন্ত-হেমপ্রভার কন্যা শান্তিলতা ও অরুণা এই মিছিলে যোগদান করেছিলেন। নজরুল ইসলাম মিছিল থেকে স্বল্পসময়ের জন্য গ্রেপ্তার হয়ে কোতায়ালী থানায় আটক থাকেন। তাঁর জীবনে প্রথম গ্রেপ্তারের অভিজ্ঞতা লাভ ঘটে। কুমিল্লার রাজনৈতিক নেতা অতীন রায়, মৌলভী আশরাফউদ্দিন আহমদ চৌধুরীসহ কয়েকজনের সাথে পরিচয় ঘটে। অতীন রায়ের সঙ্গে নজরুল ইসলামের প্রথম সাক্ষাৎ দৃশ্যটি চমকপ্রদ। অতীন রায় লিখেছেন-
‘বাসায় ঢুকেই দেখি বীরেনদা কাচারী ঘরের দরজায় হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। সঙ্গে তিনচারজন যুবক। মাথায় বাবড়ি চুল। সুন্দর সুঠাম, আকর্ষণীয় চেহারা, চোখে মুখে প্রতিভা ও তেজস্বিতার ছাপ। অধোরোষ্ঠে চাপা হাসি।’
বীরেনদা পরিচয় দিয়ে বললেন-‘নজরুল’।
বিনয়ে অভিভূত আমি নজরুলকে অকস্মাৎ এতো কাছে পেয়ে পরিয়চয় বা সাদর সম্ভাষণের কোন তোয়াক্কা না করেই বাঘের মতো লাফ দিয়ে নজরুল জড়িয়ে ধরে আমাকে। আমিও ঝাপটিয়ে ধরি আনন্দে। নজরুলের ভাবাপ্লুত দুটি মাত্র শব্দ-‘দাদারে দাদা’।
অন্যদিনের ঘটনা (১৯২২)।
বিকেলে মহেশাঙ্গনে জনসভা। লোকে লোকারণ্য। নজরুল আসেনি। বড্ড লাজুক, বক্তৃতা দিতে চান না। অতীন রায় লিখেছেন-
‘তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ধরে বেঁধে নজরুলকে নিয়ে আসি সভায়। বক্তৃতা সে দেবে না। গান গাইবে একটা এই শর্তে এসেছে। বেশ কিছু লোক এসেছে নজরুলকে দেখতে।
নজরুল গান ধরে
এসো এসো, এসো ওগো মরণ
মরণ ভীতু মানুষের ভয় করগো হরণ-
সভা নিস্তব্ধ। হাজারো চোখ নজরুলের উপর।
সঙ্গীতের শেষে এক সঙ্গে বেজে উঠে সহ¯্র হস্তের করতালি। উত্তেজিত জনতা তখন করতালির সঙ্গে জয়ধ্বনি তোলে নজরুলের নামে।’
অন্যদিকে বীরেন সেনগুপ্তও একজন রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তিনি প্রথমে ঈশ্বর পাঠশালায় শিক্ষকতা শুরু করলেও পরে কংগ্রেস পরিচালিত জাতীয় বিদ্যালয়ে (ন্যাশানাল স্কুল) শিক্ষকতা করতেন। কুমিল্লায় খিলাফত আন্দোলনের নেতা আফতাবুল ইসলামের সঙ্গেও নজরুল ইসলামের যোগাযোগ ছিল।
নজরুল ইসলাম যখন ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করলেন এবং স্বাধীনভাবে স্বদেশপ্রেমে উজ্জ্বীবিত হয়ে জ্বালাময়ী কবিতা রচনা করতে থাকেন। বিশেষত ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতা লেখার পর সরকার রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা রজ্জু করে নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। নজরুল আত্মগোপন করে কুমিল্লায় চলে আসেন এবং ধূমকেতুর স্বত্ব বিরজাসুন্দরীদেবীকে লিখে দেন। সময়টা ছিল ১৯২২ সালের নভেম্বর। ২৩ নভেম্বর তিনি কুমিল্লায় ঝাউতলায় বিকেলবেলা গ্রেপ্তার হন এবং বিচারে এক বছরের জন্য কারাবাস ভোগ করেন। এই দীর্ঘ আলোচনার উদ্দেশ্য হলো, নজরুল ইসলাম কি কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী বা সদস্য ছিলেন, অথবা রাজনৈতিক নেতা ছিলেন? কারণ তখনকার সরকারি নজরদারিতে নজরুল ইসলাম সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে কুমিল্লা-প্রসঙ্গও উত্থাপিত হয়েছে। তিনি যে বার বার কুমিল্লায় এসেছেন, তার বহুবিধ কারণ থাকলেও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশবিরোধী কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন বলেই তিনি কুমিল্লায় আসতেন এরূপ কিছু তথ্য সরকারি গোপনীয় দলিলপত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়।
[অষ্টম পর্ব পরবর্তী মঙ্গলবারে ছাপানো হবে।]