ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
শিষ্টাচার ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা
Published : Saturday, 26 June, 2021 at 12:00 AM
শিষ্টাচার ও প্রাসঙ্গিক ভাবনামোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন ||
নিকট অতীতেও লোকাল বাসে চার-পাঁচটি বাক্য প্রায়শই চোখে পড়ত “পকেটমার হতে সাবধান” “৫০০ ও ১০০ টাকার ভাঙ্গতি নাই”  “গাড়ি চলন্ত অবস্থায় চালকের সাথে কথা বলবেন না”, “ব্যবহার বংশের পরিচয়”, “অহংকার পতনের মূল” ইত্যাদি। আরও অনেক জায়গায়ই ব্যবহার এবং অহংকার সম্পর্কিত নীতি বাক্য দুটির মুদ্রায়ন চোখে পড়ে। অহংকারের পরিনতি নিয়ে বিশ্লেষণের তেমন কিছু আছে বলে আমার কাছে  মনে হয় না, কারণ এর ফলাফল প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে সাব্যস্ত করা আছে সুনির্দিষ্টভাবে। কিন্তু ব্যবহার বা আচার-আচরণ নিয়ে মহা খটকা অনুভূত হচ্ছে। মানুষের ডিগ্রি লেখা থাকে কাগজে কিন্তু শিার পরিচয় ফুটে উঠে ব্যবহারে। উৎকৃষ্ট আচরণ নাকি নিকৃষ্ট আচরণ উত্তম বংশের পরিচায়ক এটা কিন্তু বলা হয় নাই। যদি ভাল বংশের পরিচয়ে পরিচিত হতে মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হয়, দুর্ব্যবহার তাহলে ঘৃণিত বংশের পরিচায়ক এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এখন এই ধারণাটা নিয়েই কিছুদিন যাবৎ আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি। আমার সারা জীবনের লালিত ভাবনা কি তাহলে উল্টো?
এখন দেখছি বড় বংশের লোক, বেশী লেখাপড়া জানা ব্যাক্তিরা হরহামেশাই মানুষের সাথে অবলীলায় দুর্ব্যবহারে লিপ্ত হয়, হিংস্র হয়ে উঠে। অপমান করতে কোন যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু সম্মান করতে শিা লাগে, সেটা পুঁথিগত শিা নয়, সেটা পারিবারিক শিা, সামাজিক শিা। উচ্চ শিায় শিতি হয়েও যদি বিবেক বা  মনুষ্যত্ববোধ না থাকে সেই শিার কোন মূল্যই নেই। বিশ্বব্রম্মান্ডে মানব সমাজের কোন কিছুই কি চিরন্তন? সবকিছুই যখন পরিবর্তনশীল তাহলে কুলীনতাও এর উর্ধে নয়, এখানেও হয়তো পট পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। যদি বলেন  আমি খানদানী বংশের উত্তরাধিকার আর আচরণ করেন ঘৃনার উদ্রেক করার মত, তাহলে হয় চিরাচরিত ধারণা পাল্টে ফেলে মনে করতে হবে বাজে ব্যাবহারই উচ্চ বংশের পরিচায়ক, নয়তো ধরে নিতে হবে তিনি আসলে নিচু বংশের প্রতিনিধিত্ব করছেন, গায়ের জোরে আত্ম-অহমিকায় বলছেন কুলীন বংশের সন্তান এবং তা অন্যদের মানতে বাধ্য করছেন। অভদ্রতা তাদের চরিত্রের অহংকার, খারাপ আচরনের সাথে অহংকারের একটা নিবীড় সম্পর্ক যে আছে এটা মোটামুটি স্পষ্ট। অভিজাত সম্প্রদায় সাধারণ মানুষের তোষামোদী গ্রহন করতে করতেই এক সময় অহংকারী ও বদমেজাজী হয়ে উঠে, ফলশ্রুতিতে নিরীহ শ্রেনীর সাথে কটু বাক্য বর্ষন করে, অহংকারী ব্যক্তি অন্যজনের আবেগ অনুভূতিকে পিষে ফেলতে মোটেই দ্বিধা করে না। প্রকৃত শিায় অভাবগ্রস্থরাই মূলত অহংকারী হয়। সর্বকালেই সমাজে কিছু চাটুকার প্রকৃতির মানুষ থাকে যাদের কাজই হল তথাকথিত স্বঘোষিত পন্ডিত ও অভিজাতদের প্রতিষ্ঠিত করা। দৃশ্যত এরা কামিয়াব বলে মনে হলেও প্রকৃতপে এরা মানুষের মনে স্থায়ী আসন করে নিতে ব্যর্থ হয়। পৃথিবীতে যতগুলো আঘাত আছে তার মধ্যে ভংয়কর আঘাত হলো কথার আঘাত।
এই আঘাত দৃশ্যমান নয় বলে কেউ বুঝতে পারে না মানুষ কতটা আহত হয়েছে, কিন্তু এ জাতীয় আক্রমণে মানুষের হৃদয় তবিত হয়ে যায়। তাই কাউকে কিছু বলার পূর্বে ভেবে নেয়া উচিত উচ্চারিত বাক্যগুলিতে কতটা প্রভাব পড়বে বিপরীত দিকের মানুষটার মনে। নিচু কুলে জন্মানোর পর শিা-দীা, জ্ঞান-গরিমা, বিত্ত-বৈভব, আচার-আচরণ দ্বারা কালের পরিক্রমায় কারো যদি অভিজাত শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে ঘৃণিত ও আপত্তিকর কার্যকলাপের কারণে অভিজাত সম্প্রদায়েরও তো অবস্থানের অবনমন হবে প্রকৃতির নিয়মেই, নাহলে একবার যারা সমাজের উচ্চশিখরে আসীন হবে তাদের তো আর নিচে নামার ভয় থাকবে না। পান্তরে নতুন ভাল মানুষরা উপরে ওঠে গেলে সমাজে তখন একধরণের শুন্যতার সৃষ্টি হবে, কোন সামঞ্জশ্যই থাকবে না।
আর যারা সত্যিকারই কুলীন এবং পন্ডিত তারা কি কখনও এটা প্রচারে মরিয়া হয়ে উঠেন? স্মরণ রাখতে হবে নদী যত গভীর হবে বহমান ¯্রােতের আওয়াজ ততই কম হবে। বহুল প্রচলিত একটা প্রবাদ “ফলের ভাড়ে কখনও গাছ ভাঙ্গে না”। সত্যিকারের পন্ডিত-গুণীজনেরা কখনোই কারও সাথে দূর্ব্যবহারে লিপ্ত হয় না। বুদ্ধিমানেরা তো বিনয়ের দ্বারা সম্মান অর্জন করে, আর অহংকারীরা ঔদ্ধত্যের কারণে অপদস্থ হয়। তাই এ প্রকৃতির লোকদের প্রতি প্রতিশোধপ্রবন না হয়ে দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়ে গুরুত্ব কমিয়ে দেয়াই মনে হয় শ্রেয়। সেরা মানুষতো তারাই - অহংকার করার মত যোগ্যতা থাকা সত্বেও যাদের মধ্যে মোটেও অহংবোধ নেই। কিছু কিছু মানুষের কাজই হল অন্যকে তুচ্ছজ্ঞান করা। নীচু লোকের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে অশ্লীল বাক্য, ভদ্রলোকেরা ঐ নীচু জাতের লোকজনের অত্যাচার মান সম্মানের কথা চিন্তা করে নীরবে মুখ বুঝে সহ্য করে থাকে। গুনীজনেরা এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। শেষ করে দেই একটা ক্ষীনশ্রুত শ্লোক দিয়ে-
“নীচুু কুলে জন্মে যদি কেহ বড় হয়
বিদ্যা লাভ করে যদি মূর্খের তনয়
অধিক ধন পায় যদি দরিদ্রের সন্তান
এ জগৎ মনে করে তৃণের সমান।”

লেখক: সভাপতি, রোটারি কাব অব কুমিল্লা