ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
সামাজিক নৃশংসতার চার কারণ
Published : Saturday, 26 June, 2021 at 12:00 AM
সামাজিক নৃশংসতার চার কারণ ড. জিয়া রহমান ||
গত শনিবার জাতীয় জরুরি সেবা '৯৯৯' নম্বরে ফোন করে মেহজাবিন ইসলাম মুন নামে এক তরুণী বলেছেন- 'তিনজনরে খুন করে ফেলছি। তাড়াতাড়ি আসেন। দেরি করলে বাকি দুইজনরেও মাইরা ফেলব'। ঘটনাস্থল রাজধানীর কদমতলীর মুরাদপুর এলাকায় যায় পুলিশের একটি দল। সেখানে মুনের বাবা মাসুদ রানা (৫০), মা মৌসুমী ইসলাম (৪৫) ও ছোট বোন জান্নাতুল ফেরদৌস মোহিনীর (১৮) হাত-পা বাঁধা লাশ পাওয়া যায়। অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় মুনের স্বামী শফিকুল ইসলাম ও তাদের মেয়ে মারজান তাবাসসুম তৃপ্তিকে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মুন একাই তিনজনকে খুনের কথা স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
শনিবারের এ ঘটনার কিছুদিন আগে টিকটককেন্দ্রিক নারী পাচার চক্রের বহুমাত্রিক অপরাধ প্রত্য করেছি। এর কিছুদিন আগে রাজধানীর কলাবাগানে এক নারী চিকিৎসকের হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। একই এলাকায় কয়েক মাস আগে ধর্ষণের মধ্য দিয়ে কলেজপড়ূয়া এক তরুণীর হত্যাকা- ঘটে। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে।
চাঞ্চল্যকর এই তিন খুনের ঘটনা বর্তমান সময়ের অপরাধ এবং বিভিন্ন ধরনের বিচ্যুতিমূলক আচরণেরই প্রতিচ্ছবি মাত্র। প্রায় প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে এ ধরনের নেতিবাচক সংবাদ উঠে আসছে। এ ঘটনাগুলো হয়তো আমাদের কষ্ট দিচ্ছে, হয়তো আমাদের হৃদয়ে রক্তরণ হচ্ছে; কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী ও বিচারব্যবস্থাকে সামগ্রিক বিচারে আনলে এটাই প্রতীয়মান হবে যে, আমরা ভবিষ্যতেও এ ধরনের নৃশংস ও হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখতেই থাকব। এমনকি ভবিষ্যতে হয়তো এর থেকেও ভয়ংকর ঘটনা অপো করছে।
এ কথা সত্য যে, সভ্যতা বা আধুনিক সমাজব্যবস্থা সমাজ থেকে অনিয়ম, দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং এর থেকে সৃষ্ট বীভৎস সহিংস কর্মকা-কে পুরোপুরি দমন করতে পারেনি। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সবদিক থেকে সমৃদ্ধশালী দেশেও থেকে থেকে বন্দুকধারীদের হামলা, নারী নির্যাতন কিংবা বর্ণবাদী সংঘাত আমরা প্রত্য করছি। এর অর্থ, এ ধরনের অপরাধকর্মকে হয়তো আমরা সমাজ থেকে পুরোপুরি নির্মূল করতে পারব না, তবে আমরা সচেতন হলে যে মাত্রায় অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তার কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। চলমান অস্থির অবস্থা থেকে কীভাবে বের হয়ে আসা যায়, বর্তমান সময়ে এটাই সবার ল্য হওয়া উচিত।
সাম্প্রতিককালের হত্যাকা-গুলোকে বিশ্নেষণ করলে এসবের মূলে চারটি কারণ ল্য করা যায়। প্রথমত, আমরা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার প্রাথমিক স্তরে উপনীত হয়েছি। উন্নয়ন এবং প্রাথমিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার লণ হলো- আমাদের মধ্যে একদিকে যেমন লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ বেড়ে গেছে, অন্যদিকে সম্পত্তির মূল্য বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সেই হিংসা-বিদ্বেষ ও লোভের পরিমাণ আরও দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সম্পদের বিরোধকে কেন্দ্র করে পরিবারের মধ্যে সংঘাত চরম আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও আধুনিকায়নের কারণে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, স্বার্থপরতা প্রভৃতি বেড়ে যাওয়ার ফলে পরিবারের স্বজনদের মধ্যে সংহতি ও ভালোবাসা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমান সময়ের হত্যাকা-ের ঘটনাগুলোর পর্যালোচনায় দেখা যায়, এসব ঘটনার উল্লেখযোগ্যসংখ্যকই ঘটছে জমিজমা বা এ ধরনের অন্য কোনো সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে।
দ্বিতীয়ত, আমরা একটা আধুনিক সমাজব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এর ফলে আমাদের সনাতনী সমাজব্যবস্থা, চিরায়ত প্রথা-সংস্কৃতি, সনাতনী সংগঠন ও সনাতনী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা বহুলাংশে লোপ পেয়েছে। ইন্টারনেটের আসক্তি এবং ইন্টারনেটের মধ্য দিয়ে কিংবা আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে পাশ্চাত্যের বহু নেতিবাচক মূল্যবোধ বিকৃতভাবে আমাদের সমাজকে সংক্রমিত করছে। ফলে নানা ধরনের বিচ্যুতিমূলক বা অপরাধকর্ম সংঘটিত হচ্ছে। বাড়ছে বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক। আমাদের দেশে বিয়েবহির্ভূত যে সম্পর্কের অবতারণা হয়েছে, তা পরিণত পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় খুব বেশি সক্রিয় নয়। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সম্পর্ক হয়তো চিরস্থায়ী নয়, কিন্তু সেখানে ন্যূনতম নৈতিকতা দেখা যায়। সম্পর্ক চলাকালীন তাদের সম্পর্কে উষ্ণতা ল্য করা যায়। কোনো কারণে বিচ্ছেদ হলে হয়তো কিছুদিন পর তারা নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আধুনিকতার নামে ব্যক্তিস্বাধীনতার এই বিষয়টি আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। আমরা খুব দ্রুত আধুনিক মূলবোধ ধারণ করছি, কিন্তু আমাদের সমাজ থেকে সনাতনী ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এখনও পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। সে কারণে একদিকে এ ধরনের সম্পর্ক যেমন 'ট্যাবু', অন্যদিকে বিদ্যমান সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে প্রকাশ্যে নতুন সম্পর্ক শুরু করাও ব্যক্তির জন্য কঠিন। ফলে যখনই বিয়েবহির্ভূত এ সম্পর্কের কথা অন্য কেউ জেনে যায়, তখন তার মধ্যে একধরনের হীনমন্যতা তৈরি হয়, লজ্জা-ভয় কাজ করে এবং ব্যক্তি একপর্যায়ে বিধ্বংসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়।
তৃতীয়ত, আমাদের সমাজে ক্রমেই মাদকের ভয়াবহতা বাড়ছে। মাদক গ্রহণের ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক নিয়ন্ত্রণ লোপ পায়। আবার কোনো কারণে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে মাদক সেবনে বাধা এলে মাদকাসক্ত ব্যক্তি অনেক সময় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ব্যক্তি এই অসুস্থতা থেকে যে কোনো অপরাধ সংঘটনে এমনকি যে কাউকে হত্যা করতে পর্যন্ত দ্বিধা করে না। মাদক সেবন ও মাদকের কারবারে জড়িয়ে অনেকে যেমন হত্যাকা- ঘটাচ্ছে, তেমনি নিজেরাও হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে।
চতুর্থত, বর্তমান সময়ে হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো বিশ্নেষণ করলে 'গ্যাং কালচার' প্রসঙ্গটি উঠে আসে। গত কয়েক বছরে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে গ্যাং কালচার গড়ে উঠেছে। তাদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অপসংস্কৃতির চর্চা হয়। বিভিন্ন ল্েয ধর্ষণ, মাদক সেবন ও হত্যাকা-ের ঘটনাও ঘটে তাদের মাধ্যমে। বেশিরভাগ েেত্র নিজের বীরত্ব জানান দিতে বা তাদের কেউ কোনো কারণে নিজেকে লাঞ্ছিত বোধ করলে এ ধরনের হত্যাকা-গুলো ঘটতে দেখা যায়।
হত্যাকা-ের উপরোক্ত কারণগুলোকে এখনই আমলে না নিলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের নাগরিক জীবনের সংহতি এবং ব্যক্তির নিরাপত্তা বহুলাংশে হ্রাস পাবে। এতে আমাদের যাবতীয় অর্জন, উন্নয়ন ও অগ্রগতি বহুলাংশে বিনষ্ট হয়ে যাবে। পরিস্থিতি উন্নয়নে আমাদের সামগ্রিকভাবে বিচার-বিশ্নেষণ করতে হবে। আমরা দেখি, বিভিন্ন হত্যাকা-ের সঙ্গে নানা উপসর্গ জড়িত থাকে। এগুলোকে আলাদা আলাদা করে বিশ্নেষণ করে এর থেকে উত্তরণের পথ তৈরি করতে হবে।
গত শনিবার রাজধানীর কদমতলীর হত্যাকা- আধুনিক সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের প্রতিচ্ছবি। ওই নারী পুলিশকে ফোন করে সরাসরি তার বাবা, মা ও বোনোর হত্যার দায় স্বীকার করে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে নির্বিকার, বোধহীন ব্যক্তিসত্তা বা ব্যক্তির মানসিক অবস্থা ল্য করি। তার মধ্যে কোনো অনুসূচনা বা ভীতি ল্য করা যায় না। এটি আধুনিক সমাজব্যবস্থা, সামাজিক অসমতা ও পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় খুবই সাধারণ চিত্র।
উন্নত বিশ্বে ব্যক্তির এ ধরনের মানসিকতা খুবই স্বাভাবিক। অর্থাৎ সামাজিক উন্নয়ন, পুঁজিবাদ ও নগরায়ণের ফলে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং তার ফলে ব্যক্তির মনস্তত্ত্বে যে হীনমন্যতা বা হতাশা সৃষ্টি হয়, সেগুলো দূর করার জন্য একধরনের প্রক্রিয়া অত্যাবশ্যক। কাউন্সেলিং এ ধরনের মানুষকে প্রশান্তি দিতে পারে। মনোবিদ পেশার বিকাশ ও মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বিকাশের মধ্য দিয়ে মানসিক সেবা প্রসারিত করা জরুরি। হয়তো রাতারাতি দ কাউন্সিলর পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই প্রক্রিয়া শুরু করা গেলে কিছুদিনের মধ্যে নাগরিক সমাজে এর সংস্কৃতি বিকশিত হবে।
একসময় আমাদের দেশের এনজিওদের প্রধান কাজ ছিল ঋণ বিতরণ করা, পল্লি উন্নয়ন ঘটানো ইত্যাদি। যেহেতু আমরা অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি অবস্থানে উপনীত হয়েছি, এখন নাগরিক সমাজে অর্থনৈতিক উপাদানের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক উপাদানকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন এজেন্ডা নিয়ে এনজিওগুলোকে এগিয়ে আসা উচিত।
সমাজবিজ্ঞানী; অধ্যাপক, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।