কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ৮০ তম সিন্ডিকেটে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক কাজী এম. আনিছুল ইসলামের পদোন্নতি স্থগিতের সিদ্ধান্তে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিতর্ক উঠেছে, আবেদনপত্রে 'টু রেজিস্ট্রার' না থাকায় পদোন্নতি স্থগিত করা হয়েছে। তবে বিষয়টি মিডিয়ায় ভুলভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে বলে দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রশাসনের দাবি, এখানে কোন ব্যক্তি বা রেজিস্ট্রারের সম্পর্ক নেই বরং ৬৮তম সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ন অনুযায়ী যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদন করা হয়নি বলে তা স্থগিত করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৯ মে বিশ^বিদ্যালয়ের ৬৮ তম সিন্ডিকেট অনুষ্ঠিত হয়। সিন্ডিকেটে পদোন্নতির বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ‘চাকরিরত প্রার্থীদেরকে অবশ্যই যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। আবেদনকারীর আবেদনপত্র সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রার/ প্রতিষ্ঠান প্রদান কর্তৃক কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার বরাবর অগ্রায়িত হতে হবে অথবা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সরবরাহকৃত মূল আবেদন পত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধানের স্বাক্ষর ও সিল সমেত ফরওয়ার্ডেড বা অগ্রায়িত শব্দটি লেখা থাকলে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদন বলে বিবেচিত হবে’। ৬৮ তম সিন্ডিকেটের এই সিদ্ধান্তটি প্রতিটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও উল্লেখ করা থাকে। শিক্ষক আনিছুল ইসলাম যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেছেন সেখানেও এ সিদ্ধান্ত যুক্ত ছিলো।
এছাড়া ৬৮ তম সিন্ডিকেটের আগ পর্যন্ত ‘টু হোম ইট মে কনসার্ন’ লিখিত অভিজ্ঞতার সনদ দিয়ে শিক্ষকরা পদোন্নতি নিয়েছেন। কিন্তু ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ৬৮তম সিন্ডিকেটের পর থেকে রেজিস্ট্রার টু রেজিস্ট্রার ফরওয়ার্ডেড লেটার ব্যাতীত পদোন্নতি দেয়ার নিয়ম নেই।
তবে সিন্ডকেটের নিয়মানুযায়ী আবেদন পত্র ও সনদপত্র যাচাই বাছাই করার কথা থাকলেও তা অমান্য করে সম্প্রতি বিশ^বিদ্যালয়টির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক কাজী এম. আনিছুল ইসলামের পদোন্নতির সুপারিশ করে বিভাগের প্লানিং কমিটি। বিভাগের সুপারিশ অনুযায়ী রেজিস্ট্রার দপ্তরের সংস্থাপন শাখায় আবেদনপত্র জমা হওয়ার পর আবেদনপত্র যাচাই বাছাই সাপেক্ষে পদোন্নতির সাক্ষাৎকার বোর্ড আয়োজন করার নিয়ম থাকলেও সেটি মানা হয়নি। র্বোড করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এবং ৭৯তম সিন্ডিকেটে তা পাশও করা হয়। পরে শিক্ষক কাজী এম আনিছুল ইসলাম যোগদানের জন্য যোগদানপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর প্রেরণ করলে তখন শর্তপূরণ না হওয়ার বিষয়টি নজরে এলে এবং বিভিন্ন মহলে বিতর্ক শুরু হলে বিষয়টি সিন্ডিকেটে উঠায় বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন। তবে তিনি সহকারী অধ্যাপকের সমপরিমাণ বেতন পেয়ে আসছিলেন। পরে গত ২৭ জুন বিশ^বিদ্যালয়ের ৮০তম সিন্ডিকেটে এ শিক্ষকের পদোন্নতি স্থগিত করা হয়।
তবে বিশ^বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক নেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, বিশ^বিদ্যালয়ে ‘টু হোম ইট মে কনসার্ন’ লিখিত অভিজ্ঞতার সনদধারী বেশ কয়েকজন শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষক আনিছুল ইসলামের পদোন্নতির বিষয়টি জানাজানি হলে তারাও পদোন্নতির জন্য প্রশাসনকে চাপ দেন এবং শুধু একজনকেই কেন এমন বিশেষ সুবিধা দেয়া হল এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। শিক্ষকদের চাপের মুখে পড়ে প্রশাসন এ শিক্ষকের পদোন্নতির যোগদানপত্র গ্রহণ না করে বিষয়টি সিন্ডিকেটে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে শিক্ষক আনিছুল ইসলামের পদোন্নতি স্থগিতের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক নামের একটি সংগঠন এ পদোন্নতি স্থগিতের নিন্দা জানান। তবে কতৃপক্ষ বলছে, বিভাগের ভুলেই এটা এতদূর গড়িয়েছে।
তবে বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. শামিমুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার মনে হয় বিষয়টি ভিন্নভাবে উপস্থাপন হচ্ছে। এ শিক্ষকের আবেদন যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হয়নি। এ কারণে তার পূর্বের অভিজ্ঞতা গণনা করার সুযোগ নেই। ধরে নিলাম, আবেদনকারী শিক্ষক বিষয়টি জানেনা বিধায় আবেদন করেছে। কিন্তু বিভাগের প্ল্যানিং তো জানে যে, সিন্ডিকেটের এমন একটি সিদ্ধান্ত আছে। বিষয়টি সবার দৃষ্টিগোচর হলে পরে আরও শিক্ষকরাও আবেদন করেছে। এখন তাদেরকেও তো পদোন্নতি দিতে হয়। কিন্তু এতে সিন্ডিকেটের নিযম লঙ্ঘন হয়। তারচেয়ে প্রশাসন স্থগিত করেছে এ সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
এ বিষয়ে কাজী এম. আনিছুল ইসলাম বলেন, আমি আবেদন করেছি। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে বোর্ড ডাকা হয়েছে। সেখানে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে সিন্ডিকেটে তা পাশ হয়েছে। পরে আমি জয়েনিং লেটার পেয়েছি এবং যোগদান করেছি। তবে যোগদান কার্যকরের চিঠি আমাকে দেয়া হয়নি। তখন আমাকে বলা হয়েছে পরবর্তী সিন্ডিকেটে এটা ঠিক করে দেয়া হবে। আপনি আবেদনের সময় ৬৮তম সিন্ডিকেটের নিয়মটা জানতেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'আমি জানতাম। বিষয়টা হচ্ছে যে, আমি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে এটা দেখিয়েছি। উনি এটা দেখে তা ফরওয়ার্ড করেছেন। উনাদের নিয়ম এটাই। ওই লেটারে লেখা ছিলো, আমি এখানে আবেদন করছি। ‘টু রেজিস্ট্রারের’ বিষয়টা জানা না জানার বিষয় না। বিষয়টা হচ্ছে, শর্তের মধ্যে টু রেজিস্ট্রার লেখা বা না লেখার কথা বলা নাই। বলা আছে যে, রেজিস্ট্রার বরাবর। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে টু রেজিস্ট্রার বা বিস্তারিত নাই। বলা আছে যে রেজিস্ট্রার বরাবর অগ্রায়িত হতে হবে। তখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে ফরওয়ার্ডিং লেটার দিয়েছে।
তবে এ বিষয়ে জানতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির আহবায়ক ও বিভাগের প্রধান মো. বেলাল হুসাইনকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও পাওয়া যায়নি। তবে এর আগে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, ‘আবেদনপত্রে ফরওয়ার্ডেড বা অগ্রায়িত লেখা ছিলনা। শুধু একটি প্রত্যায়নপত্র ছিল। সিন্ডিকেটে উনার আবেদনপত্র বিভাগে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিভাগ যদি প্ল্যানিং করে পাঠায় তবে বোর্ড করে আবার বিবেচনা করা হবে। বিভাগ থেকে যেহেতু প্ল্যানিং কমিটি সুপারিশ করে পাঠিয়েছে এ কারণে রেজিস্ট্রার দপ্তরের সংস্থাপন শাখা তা ভালোভাবে খেয়াল করেনি। তাদেরও বিষয়টা চেক করা উচিৎ ছিল। এছাড়া একই ক্রাইটেরিয়া আরও অনেকের আছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ভিসি অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী বলেন, এখানে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অমান্য করে একজনকে পদোন্নতি দিতে হলে আরও অনেকজনকে দিতে হবে। তা না হলে তারা বঞ্চিত হবে। এসব কথা বিবেচনা করে পদোন্নতি স্থগিত করে সিন্ডিকেটে সিন্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, সেটি আবার বিভাগের প্ল্যানিং এ পাঠানো হবে। এ বিভাগ থেকে যদি ত্রুটিমুক্ত হয়ে আসতে পারে সেটা বিবেচনা করা হবে। প্রথমে এটা বিভাগের ভুল হয়েছে। এ কারণেই বিভাগে আবার পাঠানো হয়েছে।