ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
দৃষ্টি এখন কঠোর লকডাউনের ওপর
Published : Saturday, 3 July, 2021 at 12:00 AM
দৃষ্টি এখন কঠোর লকডাউনের ওপরসালেক উদ্দিন  ।।
জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে শুরু হলো দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন। এটা কারও ভাষায় লকডাউন কারও ভাষায় ‘শাটডাউন’ কারও ভাষায় ‘কারফিউ’। শাব্দিক ব্যবহার যাই হোক, দেশে এখন করোনার পরিস্থিতি যে চরম বিপর্যয় ঘটেছে তাতে সবাই এর অত্যাবশ্যকতা  সম্পর্কে একমত। সে কারণেই এই কঠোর লকডাউন দেশবাসীর প্রাণের চাহিদা।
এমতাবস্থায় মানুষের দাবি ছিল কঠোর লকডাউন এবং প্রয়োজনে ‘কারফিউ’ দেওয়া। সরকার জনগণের সেই দাবি এবং বাস্তবতার নিরিখে এবার ১ থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত যে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে তাতে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে সড়ক রেল ও নৌপথে গণপরিবহনসহ অভ্যন্তরীণ বিমান, শপিং মল, মার্কেট, দোকান, পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্র। শর্তযুক্তভাবে খোলা আছে ব্যাংক, কাঁচা বাজার, আন্তর্জাতিক ফাইট, খাবারের দোকান ইত্যাদি। বলতে দ্বিধা নেই এবার আটঘাট বেঁধে নেমেছেন সরকার। এই পদপেকে স্বাগত জানাতেই হবে।

দেশব্যাপী করোনার এই ব্যাপক বিস্তার লাভের এবং মৃত্যুযজ্ঞের পেছনে যে কারণ  সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিল তা হলো লকডাউনের ঢিলেঢালা রূপ। সে কারণে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মানিনি, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করিনি। মাস্ক পরিধানে অনীহা দেখিয়েছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি আমলে নেইনি। বাজারের বাসে লঞ্চে এমনকি পাড়ায়-মহল্লায় আড্ডা দিয়েছি। লকডাউন চললেও মূলত এটি কোনও লকডাউনই ছিল না– যা দেখারও কেউ ছিল না।
ছিল না কঠিন কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার মানুষ। ফলে দেশে গেলো বছর ৮ মার্চে করোনার প্রথম রোগী শনাক্ত ও ১৮ মার্চে প্রথম মৃত্যুর পর ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি এবং এলাকাভিত্তিক লকডাউনের করেও উল্লেখ করার মতো লাভ হয়নি।
এরইমধ্যে গেলো ঈদে লাখ লাখ মানুষ লকডাউন নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে ঢাকা ও  বিভিন্ন শহর অঞ্চল  থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঈদ উৎসবে যোগ দিতে যাওয়াটা ছিল আত্মঘাতী। তারপরেও এই ভয়ংকর ঈদযাত্রা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এদের মাঝে যারা সীমান্তবর্তী এলাকায় গেছেন তারা ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বহন করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়  ফিরেছেন। ফলে সম্প্রতি দেশের পত্রপত্রিকায় যেসব খবর উঠে এসেছে তার উল্লেখযোগ্য খবর হলো– ঢাকায় শনাক্ত করোনায় আক্রান্তদের ৬৮% ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এবং করোনায় একদিনে দেশে  সর্বোচ্চ ১৪৩ জনের মৃত্যু ও সর্বোচ্চ শনাক্তের সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার।
ওদিকে ভারতের পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশের েেত্র অর্থনৈতিক কারণেই বাঁধা ছিল না আমাদের। এসব পরিবহন ট্রাক ড্রাইভার হেলপারদের যে কদিন বাংলাদেশে অবস্থান করতে হয়েছে তারা কি ট্রাকের মধ্যে অবস্থান করেছেন? না সেটা সম্ভবও না।
তবে  সম্ভব ছিল  তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা-আইসোলেশনে রাখা। আমরা তা করতে পারেনি। তারা অবাধে বিচরণ করেছেন বাংলাদেশের যত্রতত্র যা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বিস্তারে  উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
এছাড়াও সীমান্তবর্তী এলাকায় হাট-বাজারে এপারের মানুষ ওপার, ওপারের মানুষ এপার আসা যাওয়ার নিয়ম অনিয়মের রীতি দীর্ঘদিনের। ভারতে যখন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের  মহামারি চলছে তখনও আমরা এই অবাধ যাতায়াত বন্ধ করতে পারিনি। ফলে রাজশাহী খুলনাসহ সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে মারাত্মক আঘাত হেনেছে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এসবের কারণে সারাদেশে করোনা সংক্রমণে সংখ্যা যেমন বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে তেমনি। অদূর ভবিষ্যতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মতো আমাদের বেহাল অবস্থায় পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
যদি বলি সরকারের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে নীতিনির্ধারণে একটি অস্থিতিশীলতা ছিল– তাহলে কি ভুল হবে? তাই যদি না হবে তবে বিশেষজ্ঞ কমিটির নির্দেশনা মোতাবেক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপ কার্যকর পদপে নিতে পারছিল না কেন? বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমরা যারা কলাম লিখে থাকি তারা যখন বারবার লিখেছিলাম ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বিস্তার রোধে সীমান্তে কঠোর থেকে কঠোরতম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হোক। লিখেছিলাম বর্তমান ব্যবস্থায় যেহেতু লকডাউনের ফল পাওয়া যাচ্ছে না সেহেতু সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হোক। শুধুমাত্র বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকায় অতি সম্প্রতি এ সংক্রান্ত ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ছোবল’ ‘লকডাউনের সময় বাড়ানোই সব কথা নয়’ ‘করোনা নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্সের বিকল্প নেই’ শিরোনামের আমার  লেখাগুলোতে যা বারবার লেখেছিলাম তার সারসংপে হলো, আমরা লকডাউন দিয়ে  দেখেছি, স্বাস্থ্য বিধি মানার জন্য জনসাধারণের কাছে কর্তৃপরে ব্যর্থ প্রচেষ্টা দেখেছি, সরকারি উদ্যোগে এলাকায় এলাকায় মাস্ক বিতরণ করতে দেখেছি, আবার পরীামূলকভাবে লকডাউন শিথিল করে মার্কেট,  কল- কারখানা, অফিস-আদালত  খোলে দেয়ার ব্যবস্থা  দেখেছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার হাজারো কথা বলতে শুনেছি। এলাকাভিত্তিক লকডাউনের কার্যক্রম দেখেছি। এমনকি অতিসম্প্রতি সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনার বিস্তার ব্যাপক বেড়ে গেলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে ঢাকাকে অন্যান্য জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে দেখেছি। উল্লেখ করার মতো কোনও লাভ হয়নি। বরং করোনা পরিস্থিতি ক্রমে ক্রমে এক মহামারির রূপ ধারণ করেছে।
করোনার সম্ভাব্য মহামারির হাত থেকে বাঁচতে হলে দেশব্যাপী যে স্বাস্থ্যবিধি ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন অত্যাবশ্যক তা নিশ্চিত করতে হলে সেনাবাহিনী নামানো ছাড়া আর কোনও বিকল্প যে নেই তাও এইসব লেখায় উল্লেখ করেছিলাম। উদাহরণ হিসেবে লিখেছিলাম আমরা অধিকাংশই যারা নিয়মের কোন তোয়াক্কা করি না, নিয়ম ভাঙ্গার দম্ভ নিয়ে চলি- তারাই  যখন সেনানিবাসে যাই তখন কেউই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানোর সাহস দেখাই না। এর  একটি প্রধান কারণ হলো মানুষ এখনও সেনাবাহিনীর ডিসিপ্লিনকে শ্রদ্ধা করে এবং আইন ভঙ্গকারীরা সেনাবাহিনী দেখে ভয় পায়। আর দেশকে মহামারির হাত থেকে বাঁচাতে হলে এই ভয়টিকেই  কাজে লাগাতে হবে।
যাহোক বর্তমানে  দেশব্যাপী যে  কঠোর লকডাউনের  সরকারি সিদ্ধান্ত এসেছে তাতে পুলিশ বাহিনী, বর্ডার গার্ড, র‌্যাবের সঙ্গে সেনাবাহিনী নামানোর  কথা জেনে আশ্বস্ত হয়েছি। আশা করছি এবার করোনা নিয়ন্ত্রণে যুগোপযোগী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বলতেই হবে এখন আর এক্সপেরিমেন্টের সময় নেই।
সম্ভবত সে দৃষ্টিকোণ থেকেই সরকার এবার করোনা প্রতিরোধের চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিয়েছে। আর ঢিল দেওয়ার উপায় নেই। করোনা প্রতিরোধের এযাবৎকালের পরীতি উপায় হলো সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার  নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন এবং টিকা। দেশের সর্বোচ্চ প্রতিরা ব্যবস্থা সেনাবাহিনীকে নামিয়েও যদি আমরা এসবের নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে মহামারির হাতে, মৃত্যুর হাতে দেশবাসীকে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কোনও পথ অবশিষ্ট থাকবে না।
আর দশজন আশাবাদী মানুষের মতো আমরাও বিশ্বাস করছি এই যাত্রার কঠোর লকডাউন সার্থক হবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক