মোস্তফা হোসেইন ।।
আটঘাট বেঁধেই শুরু হয়েছে
লকডাউন। কঠোর লকডাউনের প্রথমদিনে রাস্তায় নেমেছে পুলিশ, বিজিবি ও
সেনাবাহিনী। রাস্তাঘাটে যান্ত্রিক যান নেই বললেই চলে। প্রথম দিনই শাস্তির
মুখোমুখি হয়েছেন ১১৫৩ জন এবং গ্রেফতার হয়েছেন ৫৫০ জন। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক
হচ্ছে, এই মানুষগুলো বিনা কারণেই ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। এমনও
দেখা গেছে, কেউ কেউ লকডাউন দেখার জন্যই রাস্তায় নেমেছেন। তাদের আবার কিছু
অংশ মাস্ক পরারও প্রয়োজন মনে করেনি।
অন্যদিকে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী
তৈরি পোশাক শিল্পকারখানাগুলো খোলা রাখা হয়েছে। কথা ছিল প্রতিটি শিল্প
প্রতিষ্ঠান তাদের শ্রমিকদের আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু গাজীপুরে
গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিপাকে পড়তে হয়েছে কর্মস্থলে যাওয়ার সময়। অনেককে হেঁটে
যেতে হয়েছে কর্মস্থলে। মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে কঠোর লকডাউনের
প্রথম দিন। সম্ভাবনা আছে বাকি দিনগুলোতেও এমন কড়াকড়ি বহাল থাকবে।
করোনা
নিয়ন্ত্রণে সরকারের গৃহীত পদেেপর সমালোচনাকারীরাও কিন্তু সরাসরি বলছে না
লকডাউন ঘোষণা বাতিল করা হোক। অর্থাৎ তারা সরকারের সমালোচনা করলেও লকডাউনের
প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার করছে না।
প্রশ্ন হচ্ছে এই লকডাউনের কারণে
সমাজের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর কী হবে। প্রথম দিনে মালিবাগ বাজারের সামনে
দিনমজুরদের অন্তত ৩০/৪০ জনকে দেখা গেছে দুপুর পর্যন্ত বসে আছে। তাদের মুখে
মাস্ক না থাকায় হতাশার চিহ্ন স্পষ্ট দেখা গেছে। এ মুহূর্তে মনে হয় এই
শ্রেণির মানুষকে নিয়েই অধিক নজর দেওয়ার প্রয়োজন। এই মানুষগুলো শ্রম বিক্রি
করে খায়। তারা লকডাউনের কথা আগে জানার পরও ঢাকা ছাড়তে পারেনি। কিংবা ঢাকায়
থাকাটাকে অধিক নিরাপদ মনে করেছে। কিন্তু কাজ না থাকার কারণে কীভাবে তাদের
জীবন চলবে? আর তাদের সংখ্যাও কিন্তু একেবারে কম নয়।
রাজনৈতিক দলগুলো এই
বিষয়ে কিঞ্চিৎ কথাবার্তা বললেও কার্যকর কোনও পদপে তারা নেয়নি। এেেত্র
বছরকাল আগে যেভাবে বেসরকারি পর্যায়ে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছিল,
এবার তেমনটাও দেখা যাচ্ছে না। বাকি থাকে সরকারের ট্রিপল থ্রি কর্মসূচি।
নিশ্চিত বলা যায়, কোদাল-বেলচা নিয়ে বসে থাকা মালিবাগ বাজারের সামনের
মানুষগুলোর অন্তত ৯০ ভাগই জানে না, ট্রিপল থ্রি নম্বরে ফোন করলে খাবার
পাওয়া যায়। আর ট্রিপল থ্রি নম্বরে ফোন করলেই যে খাবার সরবরাহ সহজ নয়, তাও
জানা যায় গণমাধ্যমের সুবাদে। একজন রাজনৈতিক নেতা টেলিভিশনে সমালোচনাকালে
বলেছেন, ট্রিপল থ্রি-তে ফোন করে কেউ কেউ সহযোগিতা পাননি। তাঁর বক্তব্য
অনুযায়ী ট্রিপল থ্রিতে ফোন করার পর ন্যাশনাল আইডি চাওয়া হয়। আর সেখানে
এনআইডিতে যদি গ্রামের বাড়ির ঠিকানা থাকে তখন তাকে খাবার সরবরাহ করা হয় না।
এটা যদি সত্য হয়ে থাকে সঙ্গত কারণেই বলা যায়, ওই ব্যক্তিটি অস্বাভাবিক
পরিস্থিতির মুখে পড়তে বাধ্য।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির মধ্যেও এই দেশে করোনা শুরুর মুহূর্তেই সাড়ে ৩ কোটি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছিল।
অর্থনীতিবিদদের
মতে, করোনার আঘাতে দেশে এর সীমানা সম্প্রসারিত হয়েছে অনেক। কারও কারও মতে,
গত এক বছরে অন্তত আড়াই কোটি মানুষ যুক্ত হয়েছে। তার মানে প্রায় ৬ কোটি
মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমায় অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ আছে অতি
বেহাল অবস্থায়। প্রচলিত সামাজিক সুরামূলক কর্মসূচিতে তারা অন্তর্ভুক্ত নয়।
তারা মধ্যবিত্ত থেকে নতুন করে স্থান পেয়েছে সেখানে। তাদের মধ্যবিত্তসুলভ
মানসিকতা পরিবর্তন হয়নি। তারা হাত পাততে পারে না সম্মান হারানোর ভয়ে। আবার
নিজেদের চাহিদা পূরণের মতাও তাদের নেই। ট্রিপল থ্রির সহযোগিতার কথাও তারা
ভাবতে পারে না। আবার বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার মতো কিছু কর্মসূচিতে যে
সহযোগিতা কার্যক্রম চালু আছে সেই সুবিধা থেকেও তারা অধিকাংশই বঞ্চিত। এই
পরিস্থিতিতে সবচেয়ে দুর্ভোগের শিকার তারা। এই মানুষগুলোর কথা কেউ ভাবছে
না।
কর্মম মানুষ কর্মহীন হওয়ার পর যে দুর্ভোগ তৈরি হয়েছে তাদেরও কী
হবে। উদাহরণ হিসেবে পরিবহন শ্রমিকদের কথা ধরা যায়। করোনায় বারবার তাদের ওপর
আঘাত এসেছে। দফায় দফায় বন্ধ হয়েছে গণপরিবহন। গাড়ির চাকা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে
সঙ্গে তাদের চুলাও বন্ধ হয়েছে। দেশে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ পরিবহনের সঙ্গে
যুক্ত। তাদের প্রায় সবারই আয় জড়িত গাড়ির চাকার সঙ্গে। মানুষগুলো এই
মুহূর্তে সম্পূর্ণ বেকার। তাদের কথা কে ভাববে?
এপ্রিলের পর ঢাকার তিনটি
টার্মিনালে ৪ দিন ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ করেছে বলে একটি সংবাদে জানা
যায়। অন্যদিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, গত লকডাউন শেষ হওয়ার পর
প্রতি গাড়ি থেকে মালিক সমিতি ৬০ টাকা এবং শ্রমিক ফেডারেশন ৪০ টাকা করে
আদায় করেছে। পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মো. হানিফ খোকনের বরাত দিয়ে সংবাদ
হয়েছে, কয়েক মাসে ১০ লাখ গাড়ি থেকে শ্রমিক সংগঠনগুলো এক হাজার ৩৫০ কোটি এবং
মালিকরা এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা আদায় করেছে। শ্রমিকরা কি এই টাকার কোনও
অংশ পেতে পারে না? এই মুহূর্তে বাস্তবতা হচ্ছে, গাড়ি দুর্ঘটনার মতোই পরিবহন
শ্রমিকরা মহাদুর্যোগে পড়েছে।
পরিবহন শ্রমিকদের দুর্ভোগের প্রসঙ্গ
টানা হয়েছে মূলত সরকারি সহযোগিতার বাইরে নিজ নিজ ত্রে থেকে সম্ভাব্য
সহযোগিতার বিষয়টি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশে এমন আরও কিছু খাত
রয়েছে, যেখানে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানও কর্মীদের দুর্দিনে ভূমিকা রাখতে পারে।
বাস্তবতা হচ্ছে, সবকিছুতেই সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকার একটা প্রবণতাও আছে
আমাদের মধ্যে।
সত্তরের দশকেও দেখা গেছে, বন্যার মতো দুর্যোগ হানা দিলে
সামাজিক সংগঠনগুলো এগিয়ে আসতো। নিকট অতীতেও এর উদাহরণ কিছুটা হলেও ছিল।
ব্যক্তিপর্যায়ে সহযোগিতার বিষয়টিও যেন হারিয়ে গেছে। সবকিছুতেই সরকারের ওপর
নির্ভরশীলতা আমাদের এই দুর্যোগ কাটিয়ে তোলার েেত্র কতটা ভূমিকা পালন করবে
তা ভেবে দেখতে হবে।
করোনার আঘাত মোকাবিলা করা একা সরকারের পে সম্ভব হবে
বলে মনে হয় না। মোটা দাগের কাজগুলো সরকারের ওপর বর্তায় ঠিকই, কিন্তু সহায়ক
শক্তি হিসেবে সামাজিক দায়বোধকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কঠোর লকডাউন
চলাকালে এই মানুষগুলোর কী হবে সেটুকু অতি জরুরি ভিত্তিতে ভাবতে হবে। দুয়েক
দিনের মধ্যেই ওএমএস কার্যক্রম জোরালো করা দরকার। যাতে গরিব মানুষ
স্বল্পমূল্যে জীবনধারণের সুযোগ পায়। ঢাকা শহরের বস্তি এলাকাগুলোতে খাবার
পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সরকারি উদ্যোগে
খাদ্য সহায়তা করা হয়েছিল।
লকডাউনের উদ্দেশ্য সফল করতে হলে গরিব
মানুষগুলোর ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার বিকল্প নেই। সরকারের ত্রাণ মন্ত্রণালয়
এই বিষয়ে কী কার্যক্রম পরিচালনা করছে গণমাধ্যমে তা প্রচার পাচ্ছে না। ফলে
তাদের ভূমিকা নিয়েও অস্পষ্টতা রয়েছে।
বেসরকারি সহায়তা কার্যক্রম
সম্পর্কে গণমাধ্যমগুলো প্রচার করতে পারে। এতে হয়তো ইচ্ছুক মানুষগুলো এগিয়ে
আসতে পারে। এটা ঠিক, করোনার আঘাত ওই মানুষগুলোকেও করেছে। কিন্তু এখনও অনেক
মানুষ আছেন যারা অন্তত তার পাশের মানুষটির জন্য কিছু করতে পারেন। তাই এ
মুহূর্তে সরকার ও ব্যক্তি পর্যায়ে সহযোগিতা কার্যক্রম অতি জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।