মোস্তফা হোসেইন ||
আমাদের
কৃতজ্ঞতাবোধ কতটুকু? বিভিন্ন প্রসঙ্গে মাঝে মাঝেই এমন প্রশ্ন শুনি।
সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহের জন্য কুড়িগ্রাম জেলায় কিছু গ্রামে
ঘুরতে গিয়ে আরেকটি প্রশ্নের মুখে পড়েছি– আসলে আমাদের লজ্জাবোধও কি টিকে
আছে?
প্রশ্নটা মনে এসেছে, সেখানকার বীর নারীদের অবস্থান দেখার পর। কতজন
সেখানে নির্যাতিত হয়েছিলেন একাত্তরে? সঠিক কোনও পরিসংখ্যান নেই।
মুক্তিযোদ্ধা এস এম হারুনুর রশীদ লালের মন্তব্য, অন্তত শতাধিক নারী
নির্যাতিত হয়েছিলেন একাত্তরে শুধু কুড়িগ্রামের দুই-তিনটি গ্রামে। কারও মতে
এই সংখ্যা কয়েকশ’। তাদের সামান্য অংশ, বিশেষ করে একেবারেই নিম্ন আয়ের কিছু
অংশ এখন স্বীকার করছেন যে তারা একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর মাধ্যমে
নির্যাতিত হয়েছিলেন।
কুড়িগ্রামে অবস্থানকালেই আরেকটি প্রশ্নের মুখে
পড়েছিলাম– আমাদের বিশ্বাসবোধও কি অবশিষ্ট আছে? প্রশ্নটা এসেছে, যখন একজনকে
বলতে শুনলাম, ভাতার লোভে কতজনই এখন বীরাঙ্গনার তালিকায় নাম লেখাতে চাইছে!
যারা
এমন কথা বলছেন, সংখ্যার দিক থেকে তারা খুব একটা কম নয়। সন্দেহ জাগে, এমন
ভাবনা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য নিয়োজিতদের মধ্যেও আছে কিনা। এই সন্দেহের পেছনে
যৌক্তিক কারণও খুঁজে পাই। ২০১৭ সালে আবেদন করে আজও তালিকাভুক্ত হতে পারেননি
এমন বীর নারীর সংখ্যা অনেক। এই তালিকার বাইরে থাকা নারীদের অনেকেই
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীও দিয়েছেন একাত্তরে নির্যাতিত হওয়ার
বিষয়ে। এমন বঞ্চিত বীর নারী শুধু কুড়িগ্রামেই নয়। মৌলভীবাজারেও এমন বীর
নারী রয়েছেন, সেখানেও একাধিক বীর নারী আছেন, আদালতে সাক্ষী হিসেবে গৃহীত
হলেও তারা মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হতে পারেননি।
কুড়িগ্রামের এক বীর
নারী বললেন, তারা যদি আমাদের কথা বিশ্বাস না করেন তাহলে আরও মানুষকে হাজির
করতে পারবো, যারা একাত্তরের পর থেকেই নির্যাতনের কথা জানেন। একজন পুনরায়
যাচাই-বাছাইয়ের আবেদন করাকালে লিখেছেন, প্রয়োজনে তিনি আরও সাক্ষী উপস্থিত
করতে পারবেন।
একজন বীরাঙ্গনাকে এমন সাক্ষী হাজির করতে হবে, ভাবতেও অবাক
লাগে। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারী যখন বলেন আমি নির্যাতিত, তারপর
তাকে নির্যাতিত হিসেবে মনে না করার কোনও যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না।
বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের অন্তত সম্ভ্রমজ্ঞান বিশাল। তারা আর যাই
হোক নিজের সম্ভ্রমহানি মেনে নিতে পারেন না। এমতাবস্থায় যিনি নিজেকে
নির্যাতিত হিসেবে প্রকাশ করেন, তখন কোনও সাক্ষী-সাবুদ ছাড়াই তাকে
তালিকাভুক্ত করার যুক্তি আছে। কুড়িগ্রাম এলাকায় বীর নারীদের সাক্ষাৎকার
নিতে গিয়ে যে অসহনীয় বর্ণনা পেয়েছি, তাতে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় তাদের
হয়রানি করার অবকাশ নেই বলে মনে হয়েছে।
কুড়িগ্রামের নারীদের অবস্থাটা
সংক্ষেপে বর্ণনা করলে বোঝা যাবে আসলে কতটা নির্মম আচরণ করা হচ্ছে তাদের
প্রতি। কালে গ্রামের তাহেরার (ছদ্মনাম) উদাহরণই দিই। পাকিস্তানি বাহিনীর
হাতে নির্যাতিতা হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে স্বামী তাকে তালাক দেয়। তিনি চলে
আসেন বাবার বাড়ি। বাবা মেয়েকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বলেন, তুই আমার বাড়ি ছেড়ে
চলে যা। না হলে আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারবো না।
সেদিনের অসহায় এই তরুণী
কোথায় যাবেন? মা তরুণীর বাবাকে বললেন, আমার মেয়ে থাকবে এই বাড়িতেই। মেয়ে
বাড়িতে জায়গা না পেলে আমারও এই বাড়িতে থাকা হবে না। নির্যাতিত তরুণীর বাবার
স্পষ্ট জবাব, দরকার হয় তোমাকে (তরুণীর মা) আমি ত্যাগ করবো, তবু এই মেয়েকে
আমি বাড়িতে জায়গা দেবো না।
এরপর মা মেয়ের দিকেই গেলেন। মেয়েকে হাত ধরে
নিয়ে চলে এলেন তার বাবার বাড়ি। তাহেরার কোনও মামা ছিল না। নানা জায়গা দিলেন
তার মেয়ে ও নাতিনকে। সেই থেকে ৫০ বছর হয়ে গেলো, তাহেরা আছেন মায়ের সঙ্গে
নানার বাড়িতে। এখানেই শেষ নয়, তাহেরা তাদের আত্মীয়-স্বজনের বিয়ের অনুষ্ঠানে
যেতে পারেন না, একাত্তরে ধর্ষিত হওয়ার কারণে। সঙ্গে তার মায়ের ওপরও আছে
সামাজিক চাপ। সমাজের মত হচ্ছে, বীরাঙ্গনার মা, সামাজিক অনুষ্ঠানে থাকার
অধিকার রাখে না। তাই বীরাঙ্গনার মা-ও বঞ্চিত হলেন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ
নেওয়া থেকে। বীরাঙ্গনা মানে বাংলার বীর নারী এমন পাওয়ার পরও কি তাকে
প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে যে তিনি একাত্তরে নির্যাতিত?
কালে
গ্রামেরই আরেক বীর নারী অপেক্ষা করছেন কখন তালিকাভুক্ত হবেন। যাচাই-বাছাই
হওয়ার পরও তিনি তালিকাভুক্ত হতে পারেননি। হয়তো যাচাই-বাছাই কমিটি মনে করেছে
তিনি যে নির্যাতিত তা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। এ কারণে তাকে আপিল করতে
হয়েছে, তিন জন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষ্যসহ। শুধু তা-ই নয়, তাকে লিখতে হয়েছে,
যাচাই-বাছাই কমিটি যদি মনে করে তাহলে তিনি আরও সাক্ষী-প্রমাণ হাজির করতে
পারবেন।
এমন অমানবিক আচরণ কেন?
অনেক সময় পত্রিকায় পড়ি ধর্ষিত বিচার পান না, প্রয়োজনীয় সাক্ষীর অভাবে। আমাদের একাত্তরের বীর নারীদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা?
ধর্ষিত
নারীর সাক্ষী হাজির করার কোনও বিধান রাখাটা কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখা
দরকার। ধর্ষণকালে কি সাক্ষী হাজির থাকে? যে ধর্ষক সেই তো সাক্ষী। একাত্তরের
ধর্ষকরা তো এখন পাকিস্তানে। তাদের কি সাক্ষী হিসেবে পাওয়া যাবে? যদি বলা
হয়, রাজাকার ও শান্তি কমিটির কথা, যাদের কেউ কেউ হয়তো বেঁচেও আছে। এমন কেউ
কি আছে, যে নিজেকে রাজাকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগটি বেছে নেবে?
কিংবা ধর্ষকদের সহযোগী হিসেবে এই মুহূর্তে নিজেকে প্রমাণ দেবে? সুতরাং এই
বিধানটাই বিতর্কিত। তবে হ্যাঁ, কিছুটা নিয়ন্ত্রণের জন্য পাড়া-প্রতিবেশীকে
জিজ্ঞাসা করা যায়। তাও অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতিত যদি দীর্ঘদিন ঘটনা লুকিয়ে
রেখে থাকেন কিংবা ঘটনাস্থল থেকে চলে গিয়ে অন্যত্র বসবাস করেন, সেটাও
কার্যকর সম্ভব নয়। আমি মনে করি, বাংলাদেশের কোনও নারী শুধু ভাতার লোভে
নিজের সম্ভ্রমহানির মিথ্যা তথ্য দিতে পারেন না।
আরেকটি দিক হচ্ছে, যারা
তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করেছেন সংখ্যায় তারা খুবই সামান্য। প্রথমত,
নির্যাতিত অনেকেই মারা গেছেন। দ্বিতীয়ত, নির্যাতিত নগণ্য সংখ্যক ছাড়া বাকি
সবাই সামাজিক নির্যাতনের ভয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করে চলছেন। কুড়িগ্রামে একাধিক
নির্যাতিত নারীকে জিজ্ঞেস করেছি, ক্যাম্পে কি শিক্ষিত কিংবা ধনী ঘরের
মেয়েরা নির্যাতিত হয়নি? তাদের জবাব, কারও কারও সঙ্গে তাদের পূর্ব পরিচয়ও
ছিল। এখনও তাদের কেউ কেউ জীবিত আছেন। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তার কারণে তারা
মুখ খুলছেন না। মৃত এবং মুখবন্ধদের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি।
কিন্তু যারা
মুখ খুলছেন, তাদের সম্মান করার পরিবর্তে যেন অসম্মান না করা হয়।
যাচাই-বাছাইকালে যেন শিথিলতা মানা হয়, সেদিকটি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
যারা মুখ খুলছেন তাদের প্রায় সবাই হতদরিদ্র। নিরক্ষরও। অনেকেরই জন্ম তারিখ
ঠিক নেই, এমনকি নিজের নামের শেষাংশ খাতুন নাকি বেগম ঠিকমতো বলতে পারে না।
অত্যন্ত সহজ-সরল মানুষগুলোর ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা প্রয়োগ হলে মূল উদ্দেশ্যই
ব্যাহত হবে। যাচাই-বাছাইকালে সবদিক বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করি। অন্তত
তারা যেন মনে না করেন, একাত্তরে নির্যাতিত হয়েছেন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে,
৫০ বছর নির্যাতিত হয়েছেন সমাজের কাছে, এখন হতে হবে প্রশাসনের হাতে।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।