ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী ||
একটা লাটাই হাতে সুতা দিয়ে মানুষ যখন কাগজের ঘুড়িকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন মানুষ ভাবে ঘুড়িটা তার দাসত্ব বরণ করেছে। ঘুড়িটা তার বশ্যতা স্বীকার করে তার হাতের খেলনা হয়েছে। মানুষের মনস্তত্ত্ব তখন উন্মাদ হয়ে ঘুড়িটাকে যেভাবে পারে সেভাবে নাচাতে থাকে, সুতাটা যেভাবে টানে আর ছাড়ে ঘুড়িটার জীবন হয়তো তেমন একটা শেলবিদ্ধ টানাপড়নে করুণ আর্তনাদ করে কাঁদে। তবে মানুষের কান পর্যন্ত সে কান্নার শব্দ কখনো পৌঁছায় না অথবা মানুষ সেই চিৎকার শুনবে না বলে কানে তুলা দিয়ে রাখে। ঘুড়ি সাধারণত কাগজের তৈরি হয়। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু উদ্ভিদের জীবন আছে সেটা প্রমাণ করলেও কাগজের জীবন আছে এটা এখনো পর্যন্ত কেউ প্রমাণ করতে পারেনি। সে হিসেবে কাগজের ঘুড়িটা একটা জড় পদার্থ। জড় পদার্থের স্বাধীনতা-পরাধীনতার গ্লানি আছে কি না সেটা বলা কঠিন, তবে মানুষ যে জড়ের স্বাধীনতাও হরণ করতে পারে এটা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ।
একটা বড়শি হাতে মানুষ যখন মাছ শিকার করতে যায়, তখন মানুষ ভাবে তার বড়শি নামের অস্ত্রের কাছে মাছটা ধরাশায়ী হবে। বড়শিতে মাছটা আটকালে মানুষ বিজয়ীর হাসি হাসে। মানুষের মনস্তত্ত্ব তখন বলে মাছটা তার হাতে বন্দি হয়েছে, তার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অথচ কী অদ্ভুত, এই মাছটা নদীতে স্বাধীন ছিল। মানুষ সে স্বাধীনতা হরণ করলেও মুখে তা স্বীকার করে না। মানুষ খাদক হয়। এরপর মানুষ খাদকের চরিত্র ধারণ করে মাছটাকে গলা দিয়ে ঢুকিয়ে তার পেট ভরাবে। আমোদিত হবে, আহ্লাদিত হবে। তবে সে মাছটাকে হজম করতে পারবে কি না সেটা একটা জটিল দর্শনতত্ত্ব। যে মানুষ অবৈধভাবে যেটা তার খাদ্য নয় এমন কিছু খায়, সেটা সে ভোগ করতে পারে কি না কেউ জানে না। আবার নদীতে বড় মাছগুলো ছোট অসহায় মাছগুলোকে গিলে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।
এমনটা একসময় রাজা-জমিদাররা করেছেন। খাজনার নাম করে গরিব প্রজাদের শোষণ করেছেন, অত্যাচার করেছেন। নিষ্ঠুর পৃথিবীর মানুষ তার আঙুলে সুতাকে সাজিয়ে কাঠের পুতুলগুলোকে নাচায়। এটা নাকি মানুষের পেশা ছিল। অথচ সে-ও কারো না কারো হাতের পুতুল ছিল। যেমন খুশি তেমন সে-ও নেচেছে, পুতুলকেও নাচিয়েছে।
কখনো মানুষ বড় বড় মানুষের দ্বারা পরাধীন হয়েছে। কখনো মানুষ প্রকৃতির হাতে পরাধীন হয়েছে। আবার কখনো মানুষ সময়ের কাছে পরাধীন হয়েছে। খুব বিস্ময়কর একটা বিষয়, তা হলো মানুষ সবাইকে পরাধীন করতে ভালোবাসে। মানুষ কখনো কখনো জড় পদার্থের কাছে পরাধীন হয়। এই পরাধীনতার থেকে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না। মানুষ মাদকের মতো নেশার কাছে পরাধীন হয়। মানুষ টাকার কাছে পরাধীন হয়। মানুষ মন্দের কাছে পরাধীন হয়। আবদুল্লাহ আল মামুন রচিত ‘এখনো ক্রীতদাস’ নাটকটির কথা মনে পড়ল। আলো ঝলমল সুখের সুতায় বাঁধা ইট-পাথরের প্রাচীরের পর প্রাচীরে গড়া উঁচু উঁচু দালানকোঠা। নগর-মহানগর। লাল-নীল বাতি। কংক্রিটের পিচের আগুনে পোড়া রাজকীয় জনপদ। অথচ এই পাদ-প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। এই অন্ধকারকে বক্ষে ধারণ করে গড়ে উঠেছে একেকটা বস্তি। বস্তিবাসীর জীবন। সেটা জীবন কি না বলা যাবে না। তবে সেখানেই মানুষ বাস করে। প্রতিদিন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচে। সে যুদ্ধটা বৈধ, না অবৈধ সেটা ভাবার মতো সময় তাদের থাকে না। কারণ জীবন যন্ত্রণার চেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা যে আরো অনেক বেশি শক্তিশালী। গ্রাম থেকে শহরে চলে আসা ট্রাকচালক বাক্কা মিয়ার একদিন সব ছিল। অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধও করেছিলেন। অথচ সব হারিয়ে তাঁকে আজ পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে। স্ত্রী কান্দুনীর উপার্জনে কোনোমতে তাঁর সংসার চলে। রাত-দিন বিছানায় মৃত মানুষের মতো পড়ে থাকা বাক্কা মিয়ার চোখ আর মনুষ্যত্ব চেয়ে চেয়ে নির্বাক হয়ে দেখে কিভাবে অভাব মানুষকে পরাধীন করে। চোখের সামনে নিজের মেয়েকে পুরুষের লালসার কাছে বিক্রি হতে দেখেন তিনি। পচে যাওয়া ভঙ্গুর এই সমাজব্যবস্থার প্রতি তাঁর তীব্র ঘৃণা তৈরি হয়। মনটা প্রতিবাদী হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু সব কিছুই যে পরাধীনতার হাতে বন্দি, তার প্রতিবাদ ডুকরে কেঁদে মরবে হয়তো ইথার তরঙ্গে। তবে তা তথাকথিত সভ্য মানুষের কানে হয়তো কোনো দিনও পৌঁছাবে না। আধুনিক দাসপ্রথা সুতায় বাঁধা পুতুলনাচের মতো মানুষকেও গ্রাস করেছে। গবেষণায়ও সে তথ্য মিলছে। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক সংস্থা ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স ২০১৮-এ বলা হয়েছে যে বিশ্বের চার কোটিরও বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে আধুনিক দাসত্বের শিকারে পরিণত হচ্ছে। এই গবেষণায় হয়তো দৃশ্যমান বিষয়গুলোকে তুলে ধরা হয়েছে। দৃশ্যের বাইরের যে অদৃশ্য পৃথিবী রয়েছে, সেখানে কত বিচিত্রভাবে সুতার ওপরে সুতার মালা গেঁথে মানুষকে দাসে পরিণত করা হচ্ছে তার খবর কেউ রাখে না। সেটা উপলব্ধি করা যায় হয়তো, বলা যায় না। কারণ পরাধীনতাও সব সময় অদৃশ্য থাকতে ভালোবাসে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর