
অজয় দাশগুপ্ত ||
এটা এখন নিশ্চিত যে, রোহিঙ্গারা সহজে যাবে না। তাদের যাবার কোন সঠিক সময় ঠিক হয়নি। কবে হবে তাও জানে না কেউ। কিন্তু এ কথা নিশ্চয়ই জানেন কি সব হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে? সবকিছু বেসামাল আর যা তা অবস্থা এখন। খবর বলছে- বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মসজিদ ও মাদ্রাসায় সাম্প্রতিক হামলায় কয়েকজন নিহত হওয়ার পর ক্যাম্পে বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি। হামলার জন্য স্থানীয় রোহিঙ্গারা আরসাকে দায়ী করছে। যদিও আরসা হামলার দায় অস্বীকার করেছে।
এ অবস্থায় ক্যাম্পে নিরাপত্তা বাড়ানো হলেও সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক কাজ করছে। ক্যাম্পের বাইরে একের পর এক সন্ত্রাসী কার্যক্রমে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যেও ভয়-আতঙ্ক বাড়ছে। হামলার সময় তারা শুধু মসজিদ-মাদ্রাসায় আক্রমণ করেই থেমে থাকেনি, আশপাশের প্রতিটি বাড়ির সামনেও পাহারা বসায়, যাতে কেউ প্রতিরোধ করতে না পারে। আশপাশের রোহিঙ্গাদের দাবি, কয়েক শ’ রোহিঙ্গা ওই হামলায় অংশ নিয়েছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোহিঙ্গারা বলেন, এখনও তাদের হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে। প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কথা বলতেও ভয়-আতঙ্ক কাজ করছে সবার মধ্যে। ঘটনার পর সার্বক্ষণিক পুলিশের পাহারা বসেছে। চলছে দিনে-রাতে টহল। কিন্তু ক্যাম্পের পরিস্থিতি থমথমে বলেই মনে হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এই পরিস্থিতি কি সত্যি অকল্পনীয় কিছু?
বাংলাদেশের জনসংখ্যা এমনিতেই অসহনীয়। ঘনবসতির এ দেশে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা এই শরণার্থীর দল। এরা যে হিংস্র এবং সংস্কৃতিহীন এটা জানার পরও আমরা তাদের যে আদর আপায়ন দিয়েছি সেটাই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দৈনিক আমাদের সময়ের রিপোর্ট বলছে, এরা এখন বেপরোয়া। আধিপত্য বজায় রাখার নামে এরা আমদানি করছে অস্ত্র ও সন্ত্রাস। আমরা যেসব তথ্য ও প্রমাণ পাচ্ছি তাতে এটা স্পষ্ট যে, এদের গডফাদাররা সক্রিয়। এরা যুক্ত হয়েছে দেশীয় নেটওয়ার্কের সঙ্গে। বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়েছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এটাও সত্য যে, সমাজ ততটা এগোয়নি। গত কিছুদিন ধরে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সন্ত্রাস আর সাম্প্রদায়িকতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সমাজের পচন কোথায়। এটাও জানিয়ে গেছে বন্ধ্যা রাজনীতি সন্ত্রাস বা উগ্রতা দমন করতে ব্যর্থ। আরও একটা বিষয় খেয়াল করবেন এসব ঘটনায় জড়িতদের বয়সসীমা কেমন? সব ছেলের বয়স ছিল কুড়ি থেকে তিরিশের নিচে। এমনকি আঠারো-উনিশের ছেলেরাও ছিল দলে। এখন ভাবুন এদের সঙ্গে যদি রোহিঙ্গাদের উগ্রবাদীরা যোগ হয় কি হবে সমাজের?
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে যা দেখি তার নাম একটাই- একটি ভবিষ্যতহীন নির্দেশনাহীন জাতিগোষ্ঠীর উ™£ান্ত জীবন, যা নিজ দেশে অবহেলিত, প্রত্যাখ্যাত। এখন বাংলাদেশের সর্বনাশ করতে উদ্যত। এরা যে আমাদের কত ক্ষতি করবে আর সমাজকে কোথায় নিয়ে যাবে সে জিজ্ঞাসা যৌক্তিক। কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া, রামু সব এলাকা কি দেশের বাইরে? দেশেরই অংশ। যদি সেটা মাথায় থাকে কি করে সরকার এসব দমন না করে লোক দেখানো কিছু উদ্যোগ নিয়ে খুশি? কেন শক্ত হাতে দমন করা হচ্ছে না সবকিছু?
রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সব সতর্কবাণী মিথ্যা করে তারা আরও বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে। বুঝতে হবে অন্যায় আচরণে পারদর্শী এই উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দেয়াই উচিত ছিল না। কিন্তু দেশের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল যে, দরকার হলে জাতি একবেলা খেয়ে আরেকবেলা না খেয়ে এদের খাওয়াবে। কিন্তু এখন কি দেখছি আমরা? নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশচুম্বী। শুধু আকাশচুম্বী বললেও ঠিক হবে না, বলা দরকার ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাধারণ নাগরিকদের যেখানে নাভিশ্বাস উঠেছে সেখানে রোহিঙ্গাদের খাওয়াবে কে? হয়ত ধারণা ছিল অঢেল অনুদান আন্তর্জাতিক সাহায্য আর জনগণের সহায়তায় সবকিছু সম্ভব হবে। কিন্তু সরকারের অজানা ছিল না আমাদের সমাজের বাস্তবতা কি? এখানে যে যত পায় তত চায়। এই চাওয়া যে কোন উৎস থেকে হলেই চলে। বিষয় হলো টাকা। রোহিঙ্গাদের বেলায় সেটা ঘটছে। আরও যুক্ত হয়েছে মাদক। এ পর্যন্ত যতবার এ নিয়ে লিখেছি ততবার বলেছি সব থেকে ভয়ঙ্কর এই মাদক।
আজকে তারুণ্যের অধঃপতন সবার জানা। এর ওপর যদি রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাস এসে যোগ হয় পরিস্থিতি যা হবার তাই হবে। এখন এটা প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মজার বিষয় সরকার এখন বলছে এদের ব্যাপারে বিশেষত এদের ফেরত পাঠাতে কঠোর হতে হবে। কিন্তু ইটস টু লেট। চীনের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য মেরুকরণ সম্পর্ক, সঙ্গে মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক অবস্থান এটা পরিষ্কার করে দিচ্ছে যে, সহজে এদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। সরকার মুখে যাই বলুক মূলত তাদের কথা আন্তর্জাতিক মহলে আদৌ কোন প্রভাব ফেলেনি। আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি দেখতে পাচ্ছি এ নিয়ে কোন কথাবার্তাও নেই কোন মহলে। ফলে রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক ও জোর প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।
সামাজিক ভিডিও মাধ্যমে এখন যেসব ঘটনা ভাইরাল হচ্ছে তাতে এটা স্পষ্ট রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া। গলাকেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করানোর অপচেষ্টাকে সরকারী মহল বলছে ভুয়া, অপপ্রচার। কিন্তু মূল ঘটনা আমরা কেউই জানি না। বাহ্যিক ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার, এরা চাইলেই মহিবুল্লাহর মতো হত্যা করতে পারে। আমাদের দেশের যেসব ভূমি সন্তান বা মানুষ সেসব এলাকায় থাকেন তাদের জন্য এখন দুশ্চিন্তার বাইরে আর কিছু নেই। কিভাবে বড় হচ্ছে সেখানকার নবীন বাংলাদেশী প্রজন্ম? পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে আপনি তার আঁচ পাবেন না? আপনার ঘরে আগুনের হলকা এসে লাগবে না? সেভাবেই আমাদের তারুণ্যের এক অংশ এখন মাদক আর সন্ত্রাসের নতুন মন্ত্র শিখছে। শিখছে নানা কায়দা। এই ভয়াবহতার জন্য দায়ী রোহিঙ্গা সমাজ। মোদ্দা কথা রোহিঙ্গারা এখন বিষফোঁড়া। এই বিষফোঁড়া আমরাই বড় করেছি। টেনে এনেছে ওপরের মহল ও মিডিয়ার বাড়াবাড়ি। এরা ভাসানচরে যাবে না, মিয়ানমারেও যাবে না। যার মানে তারা আমাদের মূল ভূখ-ে থেকে আমাদের তরুণ-তরুণীদের ভবিষ্যত বিপন্ন করতে সচেষ্ট ও সক্রিয়।
আমরাও এক সময় শরণার্থী হয়েছিলাম একাত্তরে। কিন্তু তখন সবাই চাইত দেশে ফিরে আবার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে। আর এরা চায় থেকে যেতে। এখানে ধর্মের নামে যে অন্ধ প্রচারণা আর স্পর্শকাতরতা সেটাই শুরুতে আমাদের মন ও বিবেককে অন্ধ করে রেখেছিল। যখন আমরা ফিরেছি হুঁশে তখন অনেক বিলম্ব ঘটে গেছে। সামনে অকুল আঁধার। অজানা আশঙ্কা আর বিপন্ন ভবিষ্যত। মানবতার নামে দেশ ও সমাজের সবকিছু বিনষ্ট করতে উদ্যত রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত এখন সময়ের চাহিদা। স্তাবকতাপ্রিয় নেতারা আসল কথা বলবে না। বলতে হবে মিডিয়াকে আর মানুষকে। এদের জন্য দেশ ও সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করা কারও জন্য কখনও মঙ্গলের হবে না। ভাসানচরকেও বাঁচাতে হবে। দেশ বাঁচাতে হলে এদের বিদায় করার বিকল্প নেই।