Published : Saturday, 12 February, 2022 at 12:00 AM, Update: 12.02.2022 12:38:47 AM
যে
ছেলে তোমার/গানের পাগল/কেমন করে রুখবে তাকে? ঘরে দিয়ে আগল...। এই কবিতার
পঙ্ক্তিমালার সূত্র ধরেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে শৃঙ্খলে বেঁধে রাখা
যায়নি দামাল ছেলেদের। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবনবাজি রেখে তারা নেমেছিল
রাজপথে। প্রাণঘাতী বুলেটের ভীতিকে উপেক্ষা করে ভেঙ্গে ছিল ১৪৪ ধারা। সেই
সুবাদে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রায় প্রতিটি দিনই ছিল প্রতিবাদী
চেতনা আর দ্রোহের উত্তাপে উজ্জ্বল। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বায়ান্নর ২০
ফেব্রুয়ারি ছিল তেমনই এক তাৎপর্যপূর্ণ দিন। পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪
ধারা ভাঙ্গার বিষয়ে এ দিন নওয়াবপুরের আওয়ামী মুসলিম লীগের সদর দফতরে বৈঠক
বসেছিল। ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী, আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে
১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষের চেয়ে বিপক্ষে পড়েছিল বেশি ভোট। এ দিনের আরেক
উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নীতি-নির্ধারকদের
অনেকেই ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। বৈঠকে মওলানা ভাসানীর উপস্থিতি জরুরী
হলেও তিনি তখন মফস্বলে সফর করছিলেন। অথচ তাকে ২০ ও ২১ তারিখের মফস্বলে সফর
কর্মসূচী বাতিল করে ঢাকায় থাকার অনুরোধ করেছিলেন অলি আহাদ। তবে সেই অনুরোধে
সাড়া দেননি ভাসানী। আতাউর রহমান খানও ওই দুদিন মামলা পরিচালনার জন্য
অবস্থান করছিলেন ময়মনসিংহে।
ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হকের তথ্যসূত্রে জানা
যায়, সে দিন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখেছিলেন অলি আহাদ,
মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি গোলাম মওলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিন। ফজলুল হক হলের সহ-সভাপতি শামসুল আলম
তাদের সমর্থক ছিলেন। মোহাম্মদ তোয়াহা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে বক্তব্য পেশ
করলেও কমিউনিস্ট পার্টির ভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে তিনি ভোটদানে বিরত ছিলেন।
কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ তকীউল্লাহ বলেন,
কমিউনিস্ট পার্টি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার বিষয়ে সরাসরি কোন সিদ্ধান্ত দিতে
চায়নি। ফলশ্রুতিতে ১১-৪ ভোটে সর্বদলীয় কর্মপরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় যে, ১৪৪
ধারা ভাঙ্গা হবে না। অন্যদিকে ভোটাভুটির পরও অলি আহাদ বলেছিলেন, ‘এ
সিদ্ধান্ত আমরা মানি না। আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্র সভা হবে তাতে
১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে যদি রায় হয়, তবে আমরা ভাঙ্গার পক্ষে।’ অলি আহাদের
বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে আবুল হাশিম বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সভায় শামসুল হক
সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। তারপরও ছাত্ররা যদি ১৪৪
ধারা ভাঙ্গে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সর্বদলীয় কর্মপরিষদের বিলুপ্তি ঘটবে।
১৪৪
ধারা যারা ভাঙতে চাননি তাদের যুক্তি ছিল, সর্বদলীয় কর্মপরিষদ
নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চায়। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হলে সরকার নিপীড়নের
সুযোগ পাবে এবং নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। কর্মপরিষদে যে সব
রাজনৈতিক নেতা ছিলেন, তাদের কাছে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রামের চেয়ে পরিষদের
নির্বাচন ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে, বৈঠক চলার সময়েই অলি আহাদকে
সভাকক্ষের বাইরে ডেকে ফজলুল হকের ছাত্র আবদুল মতিন ও মেডিক্যাল কলেজের
ছাত্র এম এ আজমল ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানান। যদিও
সে বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম
ছাত্রলীগ, তাদের সহযোগী সংগঠনের প্রতিনিধিবর্গ, খেলাফতে রব্বানী পার্টি,
তমদ্দুন মজলিশ, সরকার সমর্থক বিভিন্ন হলের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা প্রায়
সবাই ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন।
অলি
আহাদের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা। সেদিন শামসুল
হকের লেখা যে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছিল, তা রচিত হয়েছিল ইংরেজীতে। অথচ তারা
সবাই সংগ্রাম করছিলেন মাতৃভাষা বাংলার জন্য।