ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
নোয়াখালী চালায় কে?
Published : Friday, 12 March, 2021 at 12:00 AM
নোয়াখালী চালায় কে?প্রভাষ আমিন ।।

আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল। শুধু বাংলাদেশ বা এই উপমহাদেশ নয়; গোটা বিশ্বেরই অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ। ৭২ বছরের পুরনো এই দলের রয়েছে দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ রাজনৈতিক ঐতিহ্য। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভেঙে পাকিস্তান গঠনের মাত্র দুই বছরের মাথায় গড়ে ওঠে আওয়ামী মুসলিম লীগ। মতায় মুসলিম লীগ। আর বিরোধী দলে আওয়ামের মানে জনগণের মুসলিম লীগ ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। ১৯৫৫ সালে নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি ছেঁটে ফেলে সংগঠনটি হয়ে ওঠে সব মানুষের। ধীরে ধীরে পরে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের মাধ্যমে এ অঞ্চলের আশা-আকাঙ্াকে ধারণ করেন।
২৩ বছরের মুক্তি সংগ্রাম আর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। গঠনের পর থেকে অন্তর্দ্বন্দ্বে বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ। বারবার ভেঙেছে। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নিজেই বেরিয়ে গিয়ে ন্যাপ গঠন করেন। স্বাধীনতার আগে-পরে বারবার ভাঙলেও আওয়ামী লীগ এখনও উজ্জ্বল নিজের জ্যোতিতেই। ষাটের দশকে এবং ৭৫-এর পর আওয়ামী লীগ অস্তিত্বের সংকটে পড়েছিল। বিশেষ করে ৭৫-এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অনেকেই আওয়ামী লীগের টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তৃণমূল কর্মীদের দৃঢ়তায় টিকে যায় আওয়ামী লীগ। অন্তর্দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত প্রায় আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তারপর থেকে তাঁর নেতৃত্বে নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগ এখন সাফল্যের চূড়ায়। টানা ১২ বছর ধরে বাংলাদেশের মতায়। তবে অন্তর্দ্বন্দ্ব কখনও পিছু ছাড়েনি আওয়ামী লীগের। এসব বড় দলে অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকা অস্বাভাবিক নয়। প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা সুস্থ হলে সেটা দলের জন্যই লাভ। আমার কেন যেন মনে হয়, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ইচ্ছা করেই জেলায় জেলায় অন্তর্দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখেন। সেটা জেলার রাজনীতির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যই হয়তো। নইলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চাইলে মুহূর্তেই একটা গ্রুপকে বিলীন করে দিতে পারেন। তারা সেটা দেন না। কোনও না কোনোভাবে দুইপই কেন্দ্রের কারও না কারও আশীর্বাদ পান। আর জেলা পর্যায়ে যতই দ্বন্দ্ব থাকুক বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ, তাই আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় রাজনীতি প্রভাবিত হয় না।
তবে গত একযুগে আওয়ামী লীগের এই আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব আরও বেড়েছে, নতুন মাত্রা পেয়েছে। কারণ, এখন মতার কাছাকাছি থাকা বা জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারা মানেই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজির নিয়ন্ত্রণ; অঢেল সম্পদের স্রোত।
আওয়ামী লীগ এমনিতেই বড় দল। গত এক যুগে এই দল আরও বড় হয়েছে। এখন পারলে বাংলাদেশের সবাই আওয়ামী লীগ করে। স্থানীয় সব নির্বাচনেই বিদ্রোহীদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় কেন্দ্রীয় নেতাদের। অনেক জায়গাতেই নৌকা ডুবে যায় বিদ্রোহের ঝড়ে। এমনকি জেলা পর্যায়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্বও আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক। বিএনপির দুই প- প্রো আওয়ামী লীগ আর অ্যান্টি আওয়ামী লীগ। চতুর বিএনপিরা স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ভালোই আছেন। বড় দল আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। তাদের ঘরের ঝগড়া ঘরে থাকুক। কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব যখন রক্তয়ী হয়, মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, তখন আমরা শঙ্কিত হই, উদ্বিগ্ন হই। মাত্র তিন সপ্তাহের ব্যবধানে নোয়াখালীতে দুইজন মানুষের প্রাণহানি প্রশ্ন তুলেছে সরকারের সমতা এবং আওয়ামী লীগের শৃঙ্খলা নিয়ে।
এটা আরও বেশি উদ্বেগের কারণ আওয়ামী লীগের দলীয় শৃঙ্খলা রার দায়িত্ব যার, এবারের দ্বন্দ্ব-সংঘাত-রক্তপাত, সেই ওবায়দুল কাদেরের নির্বাচনি এলাকাতেই। সংঘাতের একপে তার আপন ছোট ভাই কাদের মির্জা। বসুরহাট পৌরসভার টানা তিনবারের চেয়ারম্যান আবদুল কাদের মির্জা গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর প্রথম নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বলেছিলেন, শেখ হাসিনা জনগণের ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। তিনি এমনও বলেছিলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে নোয়াখালীর আওয়ামী লীগের ২/৪ ছাড়া আর কোনও এমপি পালাবার দরজা খুঁজে পাবেন না। সেই শুরু তারপর গত আড়াই মাস ধরে তিনি একের পর বোমা ফাটিয়েই যাচ্ছেন। প্রথমে ছিল কথার বোমা। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সত্যিকারের প্রাণঘাতী বোমা, গুলি, লাঠি। কাদের মির্জা শুরুতে বলেছিলেন, তিনি বড় অসুস্থতা থেকে সেরে উঠে ঠিক করেছেন, জীবনে আর মিথ্যা বলবেন না। নিজেকে তিনি সুস্থ রাজনীতির ধারক এবং আওয়ামী লীগের বিবেক হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুটি প্রাণ হারানোর পর সবাই বুঝতে পারছেন, বিবেক-টিবেক কিছু নয়; তিনিও আর দশজন লাঠিয়াল রাজনীতিবিদের মতোই একজন। আর তার এই ‘সত্যবচন’এর পেছনেও দলীয় রাজনীতি, পারিবারিক উত্তরাধিকার, টেন্ডারবাজিই মূল। অপকর্মে পিছিয়ে পড়ে তিনি আক্রমণকেই প্রতিরার শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কাদের মির্জার আক্রমণ থেকে স্থানীয় থেকে জাতীয় নেতা কেউ ছাড় পাননি। এমনকি আপন বড় ভাইও এখন তার প্রতিপ। যারাই তাকে বোঝাতে চেয়েছেন, তারাই আক্রমণের শিকার হয়েছেন। মন্ত্রী-এমপি, পুলিশ-প্রশাসন কেউই বাদ যাননি।
পত্রিকায় দেখলাম, নোয়াখালীতে প্রবল আলোচনা বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের মেয়াদ শেষে ওবায়দুল কাদের রাষ্ট্রপতি হতে পারেন। তেমনটা হলে স্থানীয় রাজনীতিতে তার উত্তরসূরি কে হবেন, দ্বন্দ্বের শুরু এটা নিয়েই। আরেকটু পেছনে গেলে, এই দ্বন্দ্ব দেবর-ভাবির। ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী নাকি কাদের মির্জাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন। এখন রাজনীতিতে ওবায়দুল কাদেরের উত্তরসূরি কে হবেন, তার স্ত্রী নাকি ভাই। এই প্রশ্নেই কোম্পানীগঞ্জের যত সংঘাত। ছেলেবেলায় দেখেছি, গ্রামে ঘরে ঘরে সুঁই-সুতার কাজে ঘরে ঘরে নানান বাণী লেখা থাকতো। তার মধ্যে একটি ছিল এমন, ‘ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন; যদিও পর হয়, নারীরই কারণ।' ওবায়দুল কাদের এখন উভয় সংকটে- ভাই বড় না বউ বড়। ওবায়দুল কাদের ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার নীরবতার পেছনের কারণ কেউ জানেন না।' প্রথম প্রথম কাদের মির্জা ওবায়দুল কাদেরকে কিছু বলেননি। এখন তাকেও ছাড়ছেন না। কোম্পানীগঞ্জের সংঘাতের একপ কাদের মির্জা, আরেক পরে সবাই ওবায়দুল কাদেরের অনুসারী। এই দ্বন্দ্বে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী। কাদের মির্জার নিয়মিত টার্গেট তিনি। তিনি ওবায়দুল কাদেরের পরিবারকে রাজাকারের পরিবার বলে আবার তা প্রত্যাহার করে আলোচনায় এসেছেন। কয়েকদিন আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘নোয়াখালী আমি চালাই।'
নোয়াখালী কে চালাবে, দ্বন্দ্ব এটা নিয়েও। একরামুল করিম চৌধুরী প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। তিনি ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করেও দলে টিকে আছেন প্রবল প্রতাপের সাথে। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সংসদ সদস্য, তার স্ত্রী স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান, তার মেয়ের জামাইয়ের নাম ইরফান সেলিম, তার মানে হাজী সেলিম তার বেয়াই। এত যার মতা, একটা জেলা চালানো তার কাছে নস্যি। কিন্তু আমরা যতদূর জানি, নোয়াখালী তো সরকারের প্রশাসনের, পুলিশের চালানোর কথা। নোয়াখালী তো বাংলাদেশের অংশ, একটা জেলা মাত্র। তবে যেভাবে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সব চলছে, তাতে মনে হয় নোয়াখালী যেন স্বাধীন হয়ে গেছে। কোম্পানীগঞ্জে সাংবাদিক মুজাক্কির এবং আলাউদ্দিনের হত্যা, সংঘাতের দায় কে নেবে, প্রশাসন নাকি একরামুল করিম চৌধুরী? যিনি নোয়াখালী চালান দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।
কোম্পানীগঞ্জের সংকটটা কিন্তু হঠাৎ করে হয়নি। প্রায় আড়াই মাস ধরে ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। কিন্তু সে আগুন নেভানোর কোনও চেষ্টা হয়নি। বরং জ্বলতে দেওয়া হয়েছে। কাদের মির্জা এতদিন যে অভিযোগ এনেছেন, তা সুনির্দিষ্ট। দলের এবং সরকারের উচিত ছিল অভিযোগগুলো তদন্ত করা। সত্য হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, মিথ্যা হলে কাদের মির্জার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু কোনোটাই হয়নি। সবাই যেন দর্শকের ভূমিকায়। সবার নিষ্ক্রিয়তায় সেই আগুন এখন ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। আমি খালি ভাবছি, কাদের মির্জা না হয়ে বিএনপির কেউ যদি এই অভিযোগগুলো করতেন, যদি এভাবে দিনের পর দিন সংঘাতে জড়াতেন; কয়দিন টিকতে পারতেন তিনি।
আমি দাবি জানাচ্ছি, একরামুল করিম চৌধুরী বা কাদের মির্জার হাত থেকে নোয়াখালী এবং কোম্পানীগঞ্জের নিয়ন্ত্রণ যেন পুলিশ এবং প্রশাসন গ্রহণ করে। মুজাক্কির এবং আলাউদ্দিনের হত্যার জন্য যে বা যারা দায়ী তাদের যেন অবিলম্বে গ্রেফতার করা হয়। অন্তর্দ্বন্দ্ব ফেসবুকে বা অফিসে করা হোক। যখনই কেউ আইন হাতে তুলে নেবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন সেই হাতকে নিয়ন্ত্রণ করে। কোনও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের হাতে নয়, নোয়াখালী-কোম্পানীগঞ্জের নিয়ন্ত্রণ থাকুক সরকারের হাতেই।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ