পর্ব-০৭
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
আমার শহর ‘কুমিল্লা’ কে নিয়ে আমি দিবা স্বপ্ন দেখতে চাই না। আমার অবলোকন ও প্রত্যাশা অনেকটাই বাস্তবভিত্তিক। ফলে কতিপয় লোকের অসন্তোষের কারণ হলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনমেজাজে অকথিত অভিব্যক্তি নিশ্চয়ই আমার চিন্তাচেতনায় সামিল হবে বলে বিশ্বাস করি।
নিকট অতীতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহর কুমিল্লার ভূমিকা ঐতিহাসিক। ২৫ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ ১৯৭১ এর মধ্যে কুমিল্লা শহরের অনেক খ্যতিমান ব্যক্তিকে পাকহানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়, শহরের চৌমাথায়, বিশেষত পূবালী চত্বর ও রাজগঞ্জ চৌমোহনায় কার্ফুহীন সময়ে লোক হত্যা করে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল, তাঁদের স্মরণে একটি স্মারক এখনও নির্মিত হয়নি। ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্ত কুমিল্লা শহরে যেখানে যে মঞ্চে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল, সেখানে ঐতিহাসিক মঞ্চ বা পতাকা উত্তোলন স্তম্ভ স্থাপন করা হয়নি, আমার শহর ‘কুমিল্লা’র রাজধানী হলো কান্দিরপাড়, তাকে যতটা প্রশস্ত রাখা যায়, ততটাই জনগণ মুক্তভাবে উপভোগ করার সুযোগ পাবে। কাজেই সিটি মার্কেটটি শহর ‘কুমিল্লা’র জন্য অভিশাপ। তেমনি বীরচন্দ্র নগরমিলনায়নের নান্দনিক অবস্থানের জন্য তার চারিদিক উন্মুক্ত রাখার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক। এক সময় কুমিল্লা জেলাপ্রশাসন অনেক স্থাপনাই উচ্ছেদ করে নগর মিলনায়তনটিকে উন্মুক্ত রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। টাউন হল মাঠ হলো কুমিল্লা শহরের ঐতিহাসিক মাঠ। এ মাঠে ব্রিটিশ আমল থেকে অনেক রাজনৈতিক নেতা ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু এ মাঠে কয়েকবার বক্তৃতা করেছেন টাউনহলের দ্বিতীয় তলার প্রশস্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এ টাউন হল হলো কুমিল্লার ইতিহাসের সাক্ষী। তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব কুমিল্লা শহরবাসীর। এছাড়া টাউনহলের যে তোরণ নির্মিত হয়েছে, তা শৈল্পিক নয়। একটি তোরণ, ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে ধারণ করে থাকে। কাজেই তোরণে থাকবে ইতিহাসের নকসা ও নান্দনিকতা।
কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী বাজার হলো রাজগঞ্জবাজার। তার কোনো পরিবর্তন নেই। অথচ বাজারটিকে ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণ করে অনেককিছু করা যেতে পারে। তদ্রƒপ রানীরবাজারকেও সংস্কার করা যায়।
শহরের রাস্তা হবে বিমানবন্দরের রাস্তার মতো। প্রতি বছর সংস্কারের নামে যতটাকা খরচ হয়, তা যদি প্রযুক্তির সহায়তায় নির্মাণ করা যায়, তাহলে নিশ্চয়ই জনভোগাক্তি হবে না। যেহেতু লোকসংখ্যা বেড়েই চলেছে, সেজন্য শহর তলিতে আবাসনের জন্য ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। আবাসনগুলোর নামকরণ হতে পারে কমলাঙ্ক, সমতট, রোশানাবাদ, ত্রিপুরা ইত্যাদি। এখন যাতায়াতের এতটা সুবিধা যে, শহরতলি বলে কথাটি হারিয়ে গেছে। শহর থেকে ১০/১৫ কিলোমিটার দূরে বসবাস করলেও শহরের সুযোগ সুবিধা পেতে কোনো কষ্ট হয় না। ঢাকা নগর কী পুরাণ ঢাকায় আবদ্ধ হয়ে আছে? কাঁচপুর বাড়ি করে বলে ঢাকায় বাড়ি করেছি। তাহলে বিজয়পুর-চৌয়ারা-কোটবাড়ী-উত্তরে শিমপুর, বানাসুয়া, ময়নামতিতে আবাসনের ব্যবস্থা থাকলে, শহর কুমিল্লার সুবিধাগুলো ভোগ করতে অসুবিধা কোথায়?
কুমিল্লা শহরের অভ্যন্তরে ভিক্টোরিয়া কলেজটিকে পূর্ণাঙ্গ ¯œাতকোত্তর পর্যায় উন্নয়ন করা হোক। এ কলেজের দুটি ছাত্রাবাসের বিশাল জায়গা রয়েছে, কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে তা বিকল্প স্থাপনার কথা শোনা যাচ্ছে। অপরদিকে অধ্যক্ষের বিশাল আবাসটি দীর্ঘদিন যাবত অরক্ষিত ও অব্যবস্থাপনায় জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে আছে, তাকে যথা মর্যাদায় নতুন আবাসন স্থাপন করা হউক। ধর্মপুরের ডিগ্রি কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দিয়ে শুধুমাত্র অনার্স ও ¯œাতকোত্তরের সঙ্গে প্রযুক্তি-বিষয়ক কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। কুমিল্লায় আইটি বিষয়টি তেমনভাবে বিকশিত হয়নি। আমার শহর ‘কুমিল্লা’র অভ্যন্তর নিয়ে যতটা চিন্তা-ভাবনা করা হয় শহরতলি নিয়ে গঠনমূলক পরিকল্পনা নেই, অথচ জনসংখ্যা বিবেচনায় ৬০% নাগরিক সেসব স্থানে বাস করে, ভোটার হিসেবেও গুরুত্ব বেশি, তারা সত্যিকার অর্থে কর্মজীবী মানুষ। তাদেরকে যদি মূলধারায় সংযুক্ত করে প্রতিষ্ঠিত করা না যায়, তবে শহর কুমিল্লার সার্বজনীন পরিচিতিতে ঘাটতি দেখা দিবে। কুমিল্লা শহর ও শহরের উপকন্ঠে কর্মজীবী মানুষদের জন্য তিনটি মিল ছিল- হালিমা-চিস্তিয়া-ময়নামতি। এগুলো ব্যক্তি মালিকানায় স্থাপিত হলেও এখন তাদের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এই বিশাল জায়গায় গার্মেন্টস শিল্প স্থাপন না করে হয়েছে আবাসিক এলাকা বা অন্য কিছু। কুমিল্লায় শিল্প-উদ্যোগ নেই বললেই চলে। অথচ জনসংখ্যার দিক বিবেচনায় রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠতে পারাটা যুগের দাবি হিসেবে অগ্রগণ্য হওয়া ছিল স্বাভাবিক। ফলে কর্মজীবী মানুষের জীবিকার সংস্থান হতো।
আমাদের অহংকার ও গৌরবের ঠিকানা হলো- কুমিল্লা একটি অসাম্প্রদায়িক জেলা, শহর কুমিল্লা অনাদি কাল থেকে সম্প্রীতির জনপদ। এখানে আমাদের একটিমাত্র পরিচয়-আমরা কুমিল্লাবাসী, কুমিল্লা শহরবাসী। ১৯৬১ সাল থেকে যা দেখে আসছি, যাদের সঙ্গে মিলে-মিশে পথ চলে সমৃদ্ধ হয়েছি, এ আমার জীবনাদর্শের হালখাতা। যে সুপারিবাগানে গুহপরিবারে থাকতাম, প্রতিবছর পুজোর সময় ড.নীলিমা ইব্রাহিম সপরিবার একসপ্তাহ বেড়াতে আসতেন, চট্টগ্রামের আয়কর আইনজীবী জামান সাহেব আসতেন, অধ্যাপক অজিতকুমার গুহের সঙ্গে পটুয়াশিল্পী কামরুল হাসান থাকতেন, দৈনিকবাংলার নগর সম্পাদক ফজলে করীমকে বাসায় রেখে বি,এ পর্যন্ত পড়িয়েছেন, দীনু বিল্লা ছিল তাঁর পালিতপুত্র। এই ছোট্ট স্মৃতিচারণে সবকথা বলা সম্ভব নয়। তারপরও বলি- ১৯২১-১৯২৩ সাল পর্যন্ত পাঁচবার কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় এসে কোন বাসায়, কার বাসায় উঠেছেন, থেকেছেন, ¯েœহাদর পেয়েছেন? কাজী জহিরুল কাইয়ুম সাহেবের আশ্রয়ে তপন রায় বলে যুবকটি প্রতিপালিত হয় নি? কাজী সাহেব পুত্রজ্ঞানে সমানাধিকার দিয়েছেন, দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর ড্রাইভার সুনীল চন্দ কি পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি? এরূপ অসংখ্য উদাহরণ। কুমিল্লার রাজনীতিবিদদের অনেকের কথাই জানি, তারা কতটা অসাম্প্রদায়িক ও ভ্রাতৃপ্রতিম। এ অহংকার কেবলমাত্র কুমিল্লার জনগণের। আমরা এদিক দিয়ে একপরিবারভুক্ত।
(ক্রমশ)
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫