সালেক উদ্দিন ।।
দেশব্যাপী করোনার গণটিকা কার্যক্রম ৭ আগস্ট থেকে চলার কথা আগে থেকেই জানা ছিল। জানা ছিল, ইউনিয়ন পর্যায়ে থেকে শুরু করে সারাদেশে এই কার্যক্রম চলবে। আগে ঘোষণা ছিল এই কার্যক্রমের আওতায় সপ্তাহে ১ কোটি মানুষকে টিকা প্রদান করা হবে। ১৮ বছর এবং তার বেশি বয়সী সবাইকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হবে। নিঃসন্দেহে এটি একটি মহৎ উদ্যোগ এবং যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত ছিল। যথারীতি গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হলো এবং প্রায় সপ্তাহকাল চলে আপাতত বন্ধ আছে। এতে পূর্ব পরিকল্পনায় পরিবর্তন এসেছিল।
টিকাদানের ল্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ কোটির স্থলে ৩২ লাখ। টিকা গ্রহীতার বয়স ১৮ বছর ঠিক রাখা সম্ভব হয়নি। ফিরে যেতে হয়েছিল কমপে ২৫ বছরে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেছিলেন, ১৮ বছর বয়সী অধিকাংশের এনআইডি নেই। সপ্তাহে এক কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার বিষয়ে বলেছেন, টিকা স্বল্পতার কারণে সেখান থেকে সরে আসতে হয়েছে। তারা পর্যালোচনা করে দেখেছেন, ১৮ বছর বয়সী অনেকের এনআইডি কার্ড নেই। ফলে ১৮ বছরকে টিকার আওতায় আনা হলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে এবং সেটা সামাল দেওয়া যাবে না।
টিকার স্বল্পতা এবং জনসামর্থ্যের বিবেচনায় সপ্তাহে ১ কোটি টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে ৩২ লাখে নির্ধারণ যথোপযুক্ত মনে হয়েছে এবং ল্যমাত্রা অর্জিতও হয়েছে।
আমার এই লেখাটির বিষয়বস্তু ১৮ বছর বয়সীদের টিকাদানে বিরত রাখা ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য দিক।
প্রথমেই বলছি ১৮-এর বেশি বয়সের ছেলেমেয়েদের টিকা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে। দেশের অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী রয়েছেন, যারা বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য অপো করছেন কিন্তু টিকা না নেওয়ার কারণে যেতে পারছেন না। এরাই দেশের ভবিষ্যৎ। জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এরাই। এদের সবারই এনআইডি কার্ড আছে। কারণ, বেশ আগেই ১৬ বছর বয়স থেকেই এনআইডি কার্ড দেওয়ার অনলাইন কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ল্য যাদের উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ যাওয়া তারা এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। আমার জানা অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা এইচএসসি/এ লেভেল শেষ করে ইউএসএ, কানাডা, ইউকেসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উচ্চশিার জন্য উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির আবেদন করেছেন এবং স্কলারশিপসহ অফার লেটার পেয়েছেন। এখন করোনা টিকার সার্টিফিকেটের জন্য ভিসার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন।
জাতির ভবিষ্যৎ এসব মেধাবী ছেলেমেয়ের টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনা অতি আবশ্যক। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার যে পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে, ছাত্রছাত্রীদের টিকা দেওয়া শুরু না করলে তা সম্ভব হবে কীভাবে? একথা অনস্বীকার্য যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। গত দেড় বছরে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ‘বারো’টা বেজেছে। শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিপথগামী হতে বসেছে। তাদের আর দীর্ঘদিন ঘরে আটকে রাখা ঠিক হবে না। ওরা বাইরে বের হবেই। এতে একাধারে টিকা না পাওয়ার কারণে নিজেরা করোনা আক্রান্ত হবে ও এর বিস্তার বাড়াবে। অপর পে জাতির মেরুদ-ের ভবিষ্যৎ নড়বড়ে হয়ে পড়বে।
শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকার আওতায় এনে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিগগিরই খুলে দিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক মহোদয় ১৮ বছর ঊর্ধ্বে বয়সের অধিকাংশেরই এনআইডি নেই বলে এখন যে কথা বলছেন– সে প্রশ্নের উত্তরে এর আগে তিনিই বলেছিলেন, প্রয়োজনে এসএসসি সার্টিফিকেট দেখিয়েও টিকা দেওয়া যাবে। তাছাড়া তিনি কি নিশ্চিত হতে পেরেছেন যে ২৫ বছর ঊর্ধ্বে সব মানুষেরই এনআইডি রয়েছে? না এখনও অনেক মানুষেরই এনআইডি কার্ড নেই। তবে কি তারা টিকা দিতে পারবেন না? নিশ্চয়ই তাদের জন্য জরুরি এনআইডি কার্ডের অন্তর্ভুক্তিসহ বিকল্প ব্যবস্থা থাকতে হবে? যেমন ১৮ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সের ছাত্রছাত্রীদের বেলায় এসএসসি সার্টিফিকেট বিবেচনায় আনার কথা ছিল।
‘তাদের সামাল দেওয়া যাবে না’ সেটাও ঠিক না। সামাল দেওয়ার দায়িত্ব তো প্রশাসনের। প্রশাসনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয় না বলেই আমরা বেসামাল হয়ে পড়ি। যেমন, গণটিকার এই কার্যক্রমের আগেই করোনার টিকা চট্টগ্রামের পটিয়ায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা যে বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম তা বলার অপো রাখে না।
৩ আগস্টের দৈনিক সংবাদপত্র যা জানান দিলো তা হলো, গণটিকা কর্মসূচি শুরুর আগেই চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে করোনাভাইরাসের প্রায় ২৬০০টি টিকা সিসি ক্যামেরা অচল করে চুরির ঘটনা। কোল্ড বক্স ছাড়াই জাতীয় সংসদের চিফ হুইপের এলাকায় ভুয়া টিকা কেন্দ্র খুলে চিফ হুইপের ভাই নিজেই অর্থের বিনিময়ে টিকা প্রার্থীদের টিকা দিয়ে তাদের চরম ঝুঁকিতে ফেলেছেন। এছাড়া গণটিকার প্রথম দিনের কর্মসূচিতে দেখলাম কমিশনার ও ইউপি মেম্বাররা যাদের টিকা দেওয়ার স্লিপ দিচ্ছেন, তারাই টিকা নিতে পারছেন। এ নিয়ে বেসামাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। টিকা নিতে আসা অনেক মানুষই ফিরে গেছেন বৃষ্টিতে ভিজে সারা দিন লাইনে থেকে।
উদাহরণ দুটি টানলাম এ কারণেই যে বেসামাল অবস্থা সৃষ্টি সিস্টেমের কারণে যেটুকু হয় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি হয় মতাসীন মানুষদের মতার অপব্যবহারের কারণে। সিস্টেমকে স্বাধীনভাবে কাজ না করতে দেওয়ার কারণে। তাছাড়া যে কমিশনাররা এবং ইউপি মেম্বাররা স্লিপ দিয়েছেন তারা কি তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং অনুসারী ছাড়া প্রতিপরে আত্মীয় অনুসারীদের স্লিপ দেবেন? এতই মহৎ তারা?
ভুলত্রুটি ধরলে এবং সমালোচনা করলেই বহু করা যাবে। পৃথিবীর যত সহজ কাজ আছে তার মধ্যে সহজতম হলো সমালোচনা করা। আজকের লেখা সেই উদ্দেশ্যে নয়। উদ্দেশ্য হলো করোনা টিকার েেত্র বয়সের সীমারেখা উঠিয়ে দেওয়া। যাদের এনআইডি আছে তাদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যবস্থা করা। টিকা চুরি এবং স্লিপ সিস্টেমসহ সব ধরনের স্বজনপ্রীতির মাধ্যম বন্ধ করা। টিকার স্বল্পতার কারণে যারা এ যাত্রায় টিকা পাবেন না তাদের পরবর্তীতে অতিসত্বর টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া। যাদের এনআইডি কার্ড নেই তাদের এনআইডি কার্ডের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আর তা যদি সম্ভব না হয় তবে আপাতত বিকল্প কোনও ব্যবস্থা করে তাদের টিকা দেওয়া। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যারা বিদেশে উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির অফার লেটার পেয়েছেন, তাদের টিকার অন্তর্ভুক্ত করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য শিার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকার ব্যবস্থা করা।
এই কথাগুলো সরকারের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই লেখা। আমরা নিশ্চিত সরকার যেভাবে টিকা সংগ্রহের অভিযান চালিয়েছে তাতে টিকার স্বল্পতা কেটে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিষয়টি জনসাধারণকে বিশ্বাস করানোর জন্য সরকারের পরিকল্পনা থাকতে হবে।
জাতির এই দুর্যোগ মুহূর্ত আমাদের অবশ্যই পূর্ব অনিয়মগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারকে যুগোপযোগী সঠিক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক