বিশেষ
প্রতিনিধি || ‘নরহত্যা মহাপাপ, তার চেয়ে পাপ আরো বড়ো/ করে যদি যারা তাঁর
পুত্রসম বিশ্বাসভাজন/ জাতির জনক যিনি অতর্কিতে তাঁরেই নিধন/ নিধন সর্বাংশে
হয়ে সেই পাপ আরো গুরুতর/... বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! থেকো নাকো নীরব দর্শক/
ধিক্কারে মুখর হও/ হাত ধুয়ে এড়াও নরক।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর
ট্রাজিক মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে’
শিরোনামে জাতির পিতার ঘৃণ্য খুনীদের প্রতি অভিসম্পাত ও ধিক্কার জানিয়ে এই
কবিতাটি লিখেন ভারতের প্রখ্যাত কবি অন্নদাশঙ্কর রায়।
আর মাত্র একদিন পরই
সেই ভয়াল দিন। যে দিনে বাঙালী হারিয়েছিল স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ তাঁর জাতির
পিতাকে, দেশকে পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল অগ্রমিছিল থেকে। বাঙালীর জীবনে শোকাহত ও
অভিশপ্ত আগস্ট মাসের আজ তেরোতম দিন।
শহরের মোড়ে, প্রধান সড়কে, অলিগলিতে
উঠছে শোকতোরণ। সকাল থেকে মধ্যরাত- বাজছে শোকগাথা। ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক
বাড়ির সামনে মনে হয় এখনও কালো ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে হাসছে যে উজ্জ্বল
চোখের দ্যুতি, একদিন তাঁরই আঙ্গুল ধরেই তো পথে নামে বাঙালী জাতি। এক সাগর
রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে মহার্ঘ্য স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা। বাঙালীর অমোঘ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের ডাকেই ঘর ছেড়েছিল মানুষ। মৃত্যুর থাবায় বুক মেলে দেয় কোটি জনতা।
শুরু করে স্বাধীনতার লড়াই। তারপর টানা ৯ মাস সেই প্রাণপ্রিয় নেতার
নির্দেশেই চলে মুক্তির যুদ্ধ। একদিন স্বাধীন হয় দেশ। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয়
আরও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র- ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
জন্ম নেন এক
চিরভাস্বর মুখ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই কালজয়ী মানুষকেই
একদিন, এই আগস্টেই নৃশংসভাবে হত্যা করে ঘাতকরা। তাঁর রক্তে রঞ্জিত হয়
বাংলার পবিত্র মাটি। বাঙালীর ইতিহাসে যোগ হয় এক কলঙ্কময় অধ্যায়। বাঙালী
কাঁদে। কাঁদায় বিশ্ববাসীকে। বুকের খুনে, বঙ্গবন্ধু রচনা করেন ভালবাসা ও
শ্রদ্ধার এক কালজয়ী ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধু মানেই একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ,
স্বাধীন পতাকা। পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার দীর্ঘ
২১৪ বছর পর ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীনতার নতুন সূর্য
উদিত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও নির্দেশে
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে বাঙালী
জাতি যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনে লাল-সবুজের রক্তস্নাত স্বাধীন পতাকা।
কিন্তু
স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় হত্যা করা হয় জাতির পিতা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ঘাতকরা চেয়েছিল ইতিহাসের চাকাকে পিছনে
ঘুরাতে। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেন কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না
পারে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের বিচার
ঠেকাতে কুখ্যাত ইনডেমনিটি বিল পাস করা হয়।
কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা
ইতিহাসের পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে পারেনি। বরং তারাই নিক্ষিপ্ত
হয়েছে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনীরা আস্ফালন করে
বলেছিল, পৃথিবীতে তাদের বিচার করার কারও সাধ্য নেই। কিন্তু নিয়তির নির্মম
পরিহাস ৭৫’র ১৫ আগস্টের ঘাতকদের বাংলার মাটিতে বিচারে ফাঁসি হয়েছে। ফাঁসির
রায়ও কার্যকরের মাধ্যমে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে
হত্যা করার পর আজও হত্যাকারী ও তাদের দোসরদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। ১৯৮১
সালের মে মাসে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগের
হাল ধরেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁর পিছু ছাড়ে না। বার বার তাঁকে হত্যার
চেষ্টা চলতে থাকে। চলে একের পর এক নগ্ন হামলা। সর্বশেষ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট
বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে শেখ হাসিনার এক সমাবেশে চলে আরেকটি নৃশংস
হত্যাযজ্ঞ। মূলত শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই ঘাতকরা ওই সমাবেশে গ্রেনেড
হামলা চালায়। কিন্তু গ্রেনেড লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় তিনি আবারও মৃত্যুজাল
ছিন্ন করে প্রাণে রক্ষা পান। তবে নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড প্রাণসংহার করে আওয়ামী
লীগ নেত্রী বেগম আইভি রহমানসহ ২৪ নেতা-কর্মীর। তাই বর্ষ পরিক্রমায় আগস্ট
এলেই সেই রক্তাক্ত স্মৃতিগুলো দেশবাসীর মনে ভেসে ওঠে। সংগ্রাম ও আন্দোলনের
সুদীর্ঘ যাত্রায় বাঙালী বঙ্গবন্ধুকে আপন করে নিয়েছিল অবিসংবাদিত নেতা
হিসেবে এবং বাঙালীর ইতিহাসের প্রধান নায়ক হিসেবে। বাঙালীর জাগরণের
চূড়ান্তপর্বে জাতি ও তাঁর নাম সমার্থক হয়ে উঠেছিল। আজও বাঙালী এবং তাঁর
পরিচয় সমার্থক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ আমাদের
প্রাত্যহিকতায় মিশে আছেন- মিশে থাকবেন জাতির অগ্রযাত্রার প্রতিটি অনুভবে-
সাহস, শক্তি ও অনুপ্রেরণা হিসেবে।